ড. মোহাম্মদ হাসান খান
আজ কোনো কিংবদন্তীর কথা নয়, একজন শিশুর কথা বলছি। যার কথা বলতে গিয়ে আমার চোখ অশ্রæসজল হচ্ছে। আমার হৃদয় বার বার আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে। যার কথা বলছি আর দশজন শিশুর মত সে বাড়ির আঙ্গিনায় খেলত, স্কুলে যেত। মা আর বড় ভাইবোনদের ¯েœহ মমতায় বড় হচ্ছিল সে। মাত্র দশ বছর বয়সে কতগুলো নরপশু তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ১৯৬৪ সালের ৩১ অক্টোবর, ধানমন্ডীর ৩২ নম্বরের ভিতর বাড়িতে ভাই বোনদের ভিড়। একটি শিশু জন্ম হয়েছে। বড় ফুপু শিশুটিকে তুলে দিলেন হাসুর কোলে। ওড়না দিয়ে মাথা মুছে হাসু শিশুটিকে নিয়ে গেলেন অন্য ভাইবোনদের কাছে। যেন ছোট একটি জীবন্ত পুতুল। কষ্টের জীবনে এক ঝলক আনন্দ। শিশুটি আর কেউ নয় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে।
সে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অতি আদরের সন্তান। বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত মুজিব দম্পতি তাদের কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখেন রাসেল। পরিবারের সবচেয়ে ছোট বলে তার প্রতি সবার ভালবাসা ছিল বেশি। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাকে চোখে চোখে রাখতেন। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল, শেখ কামালের প্রিয় ছিল রাসেল। তাকে কোলে নিয়ে শেখ হাসিনা গান-কবিতা শোনাতেন। তাকে হাত ধরে ধরে হাঁটা শিখাতেন।
রাসেলের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। যার কারণে শিশু রাসেল বাবাকে ভালোভাবে চিনত না।। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিকথায় রয়েছে, জেলখানায় পরিবারের সবাই বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছেন। রাসেল এক পর্যায়ে বলে উঠল, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি? এমন প্রশ্নে সে সময়ের উপস্থিত সবাইকে হতবাক হতে হয়েছিল। আর আজও রাসেলের এমন প্রশ্নে আমরা হতচকিয়ে যাই এবং বেদনাহত হই। এমন ঘটনা আরও আছে। ২ বছরের শিশু রাসেল জেলখানায় গিয়ে একদিন বঙ্গবন্ধুকে বলল, ‘আব্বা বালি চল।’ কিন্তু তিনি যে কারাগারে বন্দী রাসেলের সেটা বোঝার বয়স হয়নি। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন, ‘‘কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়!…দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’’ অন্য সব শিশুর মত রাসেল তার পিতার সান্নিধ্য চাইত। বঙ্গবন্ধুকে কাছে না পেয়ে বাসায় কান্নাকাটি করত। এজন্য ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রাসেলকে একদিন বললেন, তাঁকে আব্বা বলে ডাকতে। অবুঝ রাসেল সেটাই করেছিল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি ?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে। ‘রাসেল’ আব্বা আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’’
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনের রাস্তায় দুরন্ত রাসেলকে তিন চাকার একটি সাইকেলে প্রায়ই দেখা যেত। সে প্রায় সাইকেল চালাত সড়কজুড়ে। বিখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মুসা স্মৃতিকথায় রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণিতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি।…অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছোট্ট ছেলেটি। …বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এমনি করে চক্কর মারত। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। …এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা, তীক্ষè দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে।’
ছোট রাসেল চারবছর বয়সে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলে ভর্তি হয়। সে রাষ্ট্রীয় প্রটৌকল ছাড়াই সাইকেলে করে স্কুলে যেত। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রপতির ছেলে সাইকেলে করে বিনা প্েরটৗকলে স্কুলে যেত কিনা সন্দেহ। এ যেন রাষ্ট্রপতি পুত্র নয় পাড়ার আর দশজন সাধারণ ছেলের মত। ছোট ছেলেটি যেন বাবা মা আর বড় ভাইবোনদের অনুসরণ করছে। বঙ্গবন্ধু কারাগারের বাইরে থাকলে সন্তানদের সময় দিতেন। কাজের শেষে বাড়ি ফিরে সবার আগে রাসেলের খোঁজ নিতেন। রাসেল ঘুমিয়ে থাকলে ঘুমের মধ্যে তিনি তাকে আদর করতেন। জেগে থাকলে রাসেল বাবার সঙ্গ ছাড়তে চাইত না। কোলে উঠত, গল্প শুনতে চাইত। মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর চশমাও চোখে দিত রাসেল।
১৫ আগস্টের কালো রাতের হত্যাযজ্ঞ দেখে আতঙ্কিত রাসেল বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। কিন্তু তার আকুতিতে খুনীদের মন কাঁপেনি। উপরন্তু তাদেরই একজন মায়ের কাছে চল্ বলে দোতলায় নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে। টেনে হিচড়ে উপড়ে নেয়ার সময় রাসেল ভয় পেয়ে বলেছিল, আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন। তার কান্নায় পাথর হয়ত গলে যায়। কিন্তু ঘাতকদের মন গলে না। যেন সীমারের প্রেতাতœা। আইয়ুব টিক্কার বংশধর। এটি শুধুমাত্র একটি হত্যাকাÐ নয়। একটি শৈশব লুণ্ঠন করা। একটি সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটানো। শুধু রাসেল নয় যেন বাংলার সব শিশুর শৈশব হরণ করা হল। একটি হত্যাকাÐের সাথে পরিচিত করানো হল বাংলার শিশুদের। যারা হত্যা শব্দটা জানতই না তারা জানল শিশু হত্যা করা যায়। যে শিশুটি ভাবত ছোট মানেই সবাই আদর করবে তারা বুঝল তাদের জানাটা কত ভুল। নির্দ্বিধায় একজন শিশুর বুকে একটি বুলেট তাক করা যায়। ‘এ কোন মৃত্যু’, কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন।”
বেঁচে থাকলে আজ রাসেলের বয়স হত ৫৩ বছর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় এখন যেমন দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন, রাসেল বেঁচে থাকলে সেও নিঃসন্দেহে নিজেকে দেশের জন্য নিয়োজিত রাখত। শোকের মাস আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। সেই সাথে রাসেলের জন্য অনেক ভালবাসা। পরম করুনাময় তাকে ওপাড়ে ভাল রাখুন। প্রার্থনা করি পৃথিবীর আর কোন শিশুর যেন এমন অকাল নির্মম মৃত্যু না হয়। তারা যেন থাকে দুধে ভাতে, নিরাপদ মাতৃক্রোড়ে।
আরও প্রার্থনা করি সৃষ্টিকর্তা যেন আমার নেত্রীকে ধৈর্য্য দেন। তিনি যেন শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারেন। তার কাছে আামাদের আকুল আবেদন বঙ্গবন্ধু পরিবারের খুনীদের যাদের এখনও ফাঁসি হয়নি তাদেরকে দেশে এনে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা হোক। বাংলাদেশ কলঙ্ক ও অভিশাপ মুক্ত হোক।