চাঁদপুরবাসীর কৃতজ্ঞায় আবদ্ধ এসপি শামসুন্নাহার

মো. জাহিদ হাসান

সরকারি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূলত জনগনের সেবক। নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় সব ধরণের সেবা বা কল্যাণকর কাজ সমূহ সরকার প্রজাতন্ত্রের এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে সম্পাদন করে থাকে। এক্ষেত্রে কাজের ভিন্নতার কারণে প্রশাসনিক দপ্তর ও পদমর্যাদায় ভিন্নতা থাকলেও সবগুলো পক্ষের উদ্দেশ্য মূলত একই।

আর তা হলো সর্বাধিক জনকল্যাণ নিশ্চিতকরণ। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের এমন ভিন্নতায় রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ পুলিশ। গৌরবজনক ইতিহাসের অধিকারী এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রেখেছে অসামান্য অবদান।

১৯৭১ সালে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী যে ভূমিকা রেখেছে তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিন পুলিশ সদস্যরা যেভাবে নিজেদেরেকে উৎসর্গ করেছিলেন, আজ স্বাধীন দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তারাই প্রকৃত সৈনিক এবং অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

এই বাহিনীর সম্মেলিত ভূমিকা আজ দেশ ও দেশের বাহিরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আন্তজার্তিক পরিমÐলে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই বাহিনীর অনেক সদস্য জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশ নিয়ে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে রাষ্ট্রের জন্য প্রশংসা অর্জন করছেন। তবে সম্মেলিত ভূমিকার পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশ এর কতক সদস্যের দক্ষতা, যোগ্যতা আর ব্যক্তিগত নৈপুণ্য পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে দেখা যায়। এমন অনেক সংবাদ প্রায়ই আমরা গণমাধ্যমে পেয়ে থাকি। তেমনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা হলেন চাঁদপুর জেলার পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার।

ফরিদপুর জেলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কণ্যা শামসুুন্নাহার। পিতার নাম শাসছুল হক এবং মায়ের নাম আমেনা বেগম। চার ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় শামসুুন্নাহার ছোট বেলা থেকেই অনেক মেধাবী ছিলেন। জীবনের প্রথম দিকে আইনজীবী হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার সুযোগ লাভের কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়টি বিএনসিসি তে অংশ নিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন তিনি। সেরা ১০ ক্যাডেটের একজন হিসেবে রাইডার ফ্লাইংয়ে সুযোগ করে নেন মামসুন্নাহার। একজন পাইলটের সাথে উড়ার এই সুযোগ এবং বিএনসিসি তে থাকার সময় প্যারেড, অস্ত্রের সংস্পর্শ লাভ, পোশাক, নিয়ম শৃঙ্খলা তাঁকে পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা জাগায়। ইচ্ছার বাস্তব রূপ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধা ও যোগ্যতার বলে ১ম পছন্দের ক্যাডার হিসেবে ২০০১ সালে সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। এরপর বাংলাদেশ পুলিশের একজন চৌকস অফিসার হিসেবে মানিকগঞ্জ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর, ট্যুরিষ্ট পুলিশসহ বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্ব পালন করেন।

শিক্ষা জীবনে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন শামসুন্নœাহার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০০৫ সালে এমফিল এবং স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তিনি কর্মক্ষেত্রেও অসাধারণ দক্ষতা ও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। তিনি ২০০৯-১০ সময়ে জাতিসংঘ মিশনের মাধ্যমে পূর্ব তিমুর জাতীয় পুলিশের মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মকাÐের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১১-১৪ সময়টিতে তিনি জাতিসংঘের শাখা অফিস ইতালিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ সব দক্ষতার গুণে তিনি ৭ বার জাতিসংঘ শান্তিপদক লাভ করেন। বাংলাদেশ পুলিশেও তিনি তাঁর কৃতিৃত্বের চাপ রেখেছেন। যার পুরষ্কার স্বরূপ তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) অর্জন করেন এবং ৩ বার আইজি ব্যাজ প্রাপ্ত হন। এছাড়া তিনি ২০১৬ সালে উইম্যান লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করেন। তাঁর কৃতিত্ব যেন শুধুমাত্র পুরস্কারেই সীমাবদ্ধ নয়। তার অসাধারণ সব অর্জন ইতিহাসের অংশ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছে। জাতীয় ‘পুলিশ সপ্তাহ ২০১৬’ এর প্যারেডগ্রাউন্ডে প্রথম নারী প্যারেড কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসের অংশে পরিণত হন শামসুন্নœাহার। ২০১৭ সালের পুলিশ সপ্তাহেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এছাড়া তিনি মহানগর পুলিশ, রেঞ্জ পুলিশ,আমর্ড পুলিশ ও র‌্যাব সহ পুলিশের ১৩টি দলের সহ¯্রাধিক সদস্যের প্যারেডে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছেন।

তিনি ২০১৫ সালের জুন মাসে চাঁদপুর জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর যোগদানের মধ্যে দিয়ে চাঁদপুরবাসী পেল এক অনন্য গুণের অধিকারী পুলিশ সুপার। দায়িত্ব পালন কালে তিনি প্রথমেই তাঁর সততা ও সাহসের পরিচয় দিতে সক্ষম হন। একজন পুলিশ সুপার হিসেবে নির্ধারিত রুটিন কাজের বাইরে এসে নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে কাজ সম্পাদনে তিনি তাঁর দক্ষতা ও নৈপুণ্যকে কাজে লাগাতে সক্ষম হন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাতে নেন বেশ কিছু সময়পোযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ। তাঁর এ চেষ্টা শুধুমাত্র জেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সীমাবদ্ধ ছিলো না। বরং আইন শৃঙ্খলার পাশাপাশি প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য সকল উপাদান বা শক্তি সমূহের উপর তিনি নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় সক্ষমতা দেখান। যা খুব অল্প সংখ্যক অফিসারগণই পেরে থাকেন। চাঁদপুরবাসী তাঁর কাছ থেকে সুষ্ঠু আইন শৃঙ্খলার পাশাপাশি সামাজিক সমস্যার র্নিমূলে বেশ কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছে। মাদক, বাল্য বিবাহ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বরাবরই একজন সাহসী যোদ্ধা। তিনি এসব সমস্যা থেকে যুব সমাজকে দূরে রাখাতে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন কো-কারিকুলাম কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ফুটবল টুর্নামেন্ট, রচনা প্রতিযোগীতা, কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগীতা এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তিনি চাঁদপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সারা দেশের মধ্যে প্রথম বারের মত প্রবর্তন করেন মাদক, বাল্য বিবাহ ও জঙ্গিবাদ বিরোধী ফুটবল টুর্নামেন্ট- ২০১৮। চাঁদপুর জেলার ৮ টি উপজেলার প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে যুব সমাজের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে আজ ( ১০আগষ্ট, ২০১৮) হাজীগঞ্জ উপজেলা একাদশ বনাম কচুয়া উপজেলা একাদশ লড়বে। এতে বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান, চাঁদপুরের কৃতি সন্তান জাবেদ পাটোয়ারী (পিপিএম) সহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। প্রায় ১ বছর ধরে চলমান এই টুর্নামেন্টে প্রায় ১৮শ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয় মাদক, বাল্য বিবাহ ও জঙ্গিবাদ বিরোধী এই টুর্নামেন্টে জেলার প্রায় ২০ হাজারের অধিক যুব খেলোয়ার অংশ নেয়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, মাদক নিয়ন্ত্রন এর পাশাপাশি জেলাব্যাপী ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাল্য বিবাহকে কাম্য স্তরে আনতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সাথে চাঁদপুরে জঙ্গিবাদকেও তিনি সম্মেলিত প্রচেষ্টায় রুখে দিতে পেরেছেন। চাঁদপুরে তিনি দরিদ্র সাধারণ জনগোষ্ঠীর ন্যায় বিচার প্রাপ্তি তথা নারী নির্যাতন রোধ, পারিবারিক কলহ থেকে মামলা, দীর্ঘ দিন ধরে চলমান মামলা বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের সম্মতিতে নিস্পত্তির ব্যবস্থা করেন। তিনি চাঁদপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন বিচার কার্যক্রম সেলর চালু করে বিচার প্রার্থী অনেক পরিবারকে সুষ্ঠু মীমাংসার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর এই কার্যক্রম দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। চাঁদপুরে প্রায় ৪ বছরের কর্মসময়ে এমন সব কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে পুলিশ সুপার সামছুন্নাহার চাঁদপুরবাসীর অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন।

গত ১ আগষ্ট তারিখে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস স্বাক্ষরিত এক আদেশে তিনি চাঁদপুরের দায়িত্ব থেকে পরিবর্তিত হয়ে গাজীপুর জেলার দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ পান। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি এ আদেশ মানতে বাধ্য। কিন্তু প্রায় ৪ বছর ধরে তিনি যে চাঁদপুরবাসীর জন্য কল্যাণকর কাজের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেই চাঁদপুরবাসী তাঁর বদলিজনিত এ আদেশে আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত। কোন ভাবেই যেন জেলাবাসী এ আদেশকে মানতে পারছেন না। কিন্তু তারপরও মানতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে অনেকেই তো আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু কজনই বা শামসুন্নাহার হতে পারে। তিনি পেরেছেন। কর্মগুণে তিনি হয়ে উঠেছেন জেলাবাসীর প্রিয় শামসুন্নাহার। তাঁর এ চলে যাওয়া সবাইকে অনেক কষ্ট দিবে। তবে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার মহৎ ও কল্যাণকর কাজের জন্য চাঁদপুর জেলাবাসীর কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকবেন।

লেখক পরিচিতি:
মো. জাহিদ হাসান
শিক্ষক, লেখক ও কলামিষ্ট
মোবাইল: ০১৮১১-১৭৫৭৩০
ইমেল : jahidhasan278@yahoo.com

একই রকম খবর

Leave a Comment