চাঁদপুরে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র

“গুজবে কান না দিতে চাঁদপুর পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরের আহবান..

আহম্মদ উল্যাহ : চাঁদপুরের সর্বত্র ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে । একটি চক্র এই গুজব ছড়াচ্ছে । ছড়িয়ে গুজব ছড়িয়েছে- ‘পদ্মা সেতু ও চীনা কোম্পানির নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা প্রয়োজন!’ একুশ শতকে এসেও এমন গুজব চাঁদপুর শহরে এখন রীতিমত মহামারী আকার ধারন করেছে, যা নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অনেকে আশঙ্কা করছেন এ ধরনের গুজবের কারণে হয়রানীসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকারও হতে পারে নিরাপরাধ মানুষও।

এদিকে গুজবে কান না দিতে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরের আহবান জানিয়েছেন । সেই সাথে গুজবকারী প্রতারকচμকে ধরিয়ে দিতে আহবান জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে ‘ছেলেধরা’ ও ‘গলাকাটা’ বাহিনীর সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হলেও পুলিশ জানিয়েছে আটকৃতরা অধিকাংশই ছিলো মানুষিক রোগী। প্রশাসন বলছে চাঁদপুরে গলাকাটা বাহিনী বা ছেলেধরার কোন অস্তিত্ব নেই এগুলো ‘স্রেফ  গুজব’।

উদ্বেগ প্রকাশ করেছে চাঁদপুরের সুশীল সমাজের নাগরিকরাও। গুজবের গল্পে প্রতিদিনই মিথ্যার নানা ডালপালা ও রং ছড়াচ্ছে। অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লিখছেন ‘অমুক গ্রামে’ একজনকে নিয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার এই ‘গলাকাটা বাহিনী’র সাথে প্রশাসনের সম্মৃক্ততা উল্লেখ করে লিখছেন, ধরতে পারলে পুলিশে না দিয়ে নিজেরাই বিচার করুন। চাঁদপুর জেলা ও উপজেলা শহর থেকে গ্রাম সবখানেই এখন এই গুজব চলছে।

এক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানান, ‘এই গুজব এখন চাঁদপুর শহরসহ গ্রাম অঞ্চলে মহামারী আকার ধারন করেছে। অনেকে অভিভাবক বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন। আবার কেউ বাচ্চা নিয়ে স্কুলে হাজিরা দিচ্ছে। শুধু তাই না সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে ছোট শিশুদের নিয়ে বের হতে গিয়ে বাবা-মারাও বিড়ম্বনা কিংবা হয়রানি শিকার হতে পারেন। দেখা গেছে কোনো কারণে বাচ্চা কাঁদছে তখন অনেকে ভুলসন্দেহ করে হয়রানি করতে পারে।’

আতঙ্কে আছে বাচ্চারাও। একাধিক অভিভাবকরা জানান, এলাকায় ‘ছেলে ধরা’ বা ‘গলা কাঁটা’ আসছে এমন খবরে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে। কোন ভাবে তাদের কে স্কুলে একা একা পাঠাতে পারছি না। আবার রাজী হলেও আমাদের কে সঙ্গে যেতে হয়। বসে থাকতে হয় স্কুলের সামনে না হয় স্কুলের আশেপাশে।

চাঁদপুরের বেশ কয়েক সরকারি-বেসরকারি স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গলা কাঁটার গুজবে কয়েকদিন ধরে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। তবে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে প্রতিটা ক্লাসে গলা কাঁটার বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব বলে বুঝানো হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত হওয়ার জন্য শিক্ষকরা অভিভাবকদেরকে ফোনও দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে কয়েকটি স্কুল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে চাঁদপুরের জনবান্ধব পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বিপিএম, পিপিএম মহোদয় তাঁর ফেসবুকে সতর্ক বার্তা দিয়ে স্ট্যাটাসে জানান “ প্রিয় চাঁদপুরবাসী, আসসালামু আলাইকুম। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতিপয় স্বার্থানেষী মহল পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে মর্মে বিভ্রান্তি/গুজব ছড়াচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষুক/প্রতিবন্ধি/ভরঘুরে মহিলা/পুরুষদের আটক করে গণপিটুনির ঘটনা গটাচ্ছেন। প্রতিটি ঘটনা আমাদের নজরে আসছে এবং যারা এর পিছনে আছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। এরুপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না করার জন্য সকলকে অনুরোধ করা গেল। পুনরায় একই ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা/ঘটালে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্ব্বোচ্চ আইনানুগত ব্যবস্থ গ্রহণ করা হবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে শকুনীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ বাহীনী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।” নিবেদক চাঁদপুর পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বিপিএম, পিপিএম।

তিনি আরো জানান,“ আমার পেইজ (SP CHANDPUR) এর সাথে যারা যুক্ত আছেন আপনাদের সকলের প্রতি আমার অনুরোধ থাকলো আপনাদের আশেপাশে কাউকে যদি এই সংক্রান্ত কোন ধরনের বিভ্রান্তীমূলক তথ্য কিংবা গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াতে দেখেন তাহলে আমাকে ঐ সকল পোষ্টের স্কীনশট ইনবক্স করুন।

এবিষয়ে চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জাহেদ পারভেজ চৌধুরী, পুলিশ মিডিয়া সেলস এর এক স্ট্যাটাসে জানান, চাঁদপুর পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বিপিএম, পিপিএম এর নির্দেশে পুরো চাঁদপুরে সাইবার প্রোট্রালিং শুরু করেছে ডিবি, থানা পুলিশ এবং জেলা বিশেষ শাখা। ইতিমধ্যেই বেশকিছু ফেসবুক আইডি সনাক্ত করা হয়েছে এবং সেগুলোকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে পুলিশ।

তিনি আরো জানান, যেকোনো ধরনের গুজব রটনাকারীর ব্যাপারে পুলিশকে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করে (SP CHANDPUR) এর অফিশিয়াল ফেসবুকে আহবান জানানো হয়েছে। গুজব সৃষ্টিকারীরা নাশকতা ও অস্থিরতা তৈরী করে অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি তৈরী করতে চায়। এজন্যই এ সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য ও ফেসবুক আইডি দ্রুত পুলিশের নজরে আনুন। মনে রাখবেন গুজবের শিকার হয়ে আপনি নিজেও বিপদে পড়তে পারেন ।

চাঁদপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাসিম উদ্দিন জানান, ‘ছেলে ধরা খবরটি একদমই গুজব। চাঁদপুরের কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে- এখন পর্যন্ত তার কোন সত্যতা মেলেনি। তবে গ্রামের অতি উৎসাহী কিছু লোক ছেলে ধরা গুজবে কয়েকজন মানসিক প্রতিবন্ধী ও ভিক্ষুককে মারধরের করেছে। যা অত্যন্ত দু:খজনক।’

তিনি তাঁর ফেসবুক আইডিতে সচেতনামূলক এক স্ট্যাটাসে বলেন, প্রিয় চাঁদপুরবাসী, গুজবে কান দিবেন না। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে এবং এলাকার ছেলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কথাটিক গুজব ও মিথ্যা। আপনি আপনার এলাকার ছেলে-মেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠান। পুলিশ প্রশাসন আপনার পাশে আছে। যারা ছেলে ধরা বলে নিরীহ লোককে মারধর করতেছে তারা আইনের আওতায় আসবে।

বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) সকাল ১০টায় বাগাদী ইউনিয়নের নিজ গাছতলায় এক পাগলকে “গলাকাটা” সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে আহত করেছে এলাকাবাসী। পরে পুলিশ হেফাজতে উদ্ধার হয়েছে পাগ।

এদিকে চাঁদপুরের বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কোথাও থেকে এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন গুজবে গলাকাটা বস্তাওয়ালা ভেবে এক পাগলিনীকে (৬৫) নাজেহাল করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী। বুধবার (১০ জুলাই) দুপুরে শাহরাস্তি পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কাজিরকামতা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, বুধবার দুপুরে ওই গ্রামের বড় বাড়ি সংলগ্ন রাস্তার মাথায় অজ্ঞাত পাগলিনীকে ঘুরা ফেরা করতে দেখে স্থানীয় লোকজন। এমন সময় কে বা কারা ওই মহিলাকে পদ্মা সেতুর গলা কাটা গ্রুপের লোক বলে আখ্যা দিলে হুজুগে লোকজন তাকে মারধর করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ন‚র মোহাম্মদ মোল্লার ব্যবসায়িক কার্যালয়ে নিয়ে যায়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ তাকে থানা হেফাজতে নেয়।

শাহরাস্তি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, থানা হেফাজতে নেয়া মহিলাটি মানসিক বিকারগ্রস্ত। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি তার বাড়ি নেত্রকোনা সদর থানায়। পরিবারের লোকজন এলে তাদের জিম্মায় তাকে দেয়া হবে।

শাহরাস্তি অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ শাহ আলম জানান, হেফাজতে থাকা মহিলাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তরের চেষ্টা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো গুজবে হুজুগে কিছু লোকজন এসব করছে। গুজবে কান না দেয়ার জন্য তিনি এলাকাবাসীর কাছে আহবান জানান।

অন্যদিকে বুধবার (১০ জুলাই) দুপুরে উপজেলার ১৫নং রুপসা উত্তর ইউনিয়নের গাব্দেরগাঁও গ্রামের নারিকেল তলায় সন্দেহভাজন অপরিচিত একজনকে ধরে স্থানীয়রা বেদম প্রহার করে। খবর পেয়ে সংবাদকর্মীরা সেখানে ছুটে যান। গিয়ে জানতে পারে লোকটি নারিকেল তলায় গাছের নিচে বসে রয়েছে। লোকজন তার কাছে জানতে চায় বাড়ি কোথায়? লোকটির জবাব রাঙ্গামাটি। এই একটি শব্দই বলতে পারে লোকটি। তার নাম কি তাও বলতে পারছে না সে। পরে ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ এসে লোকটিকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

একই রকম খবর