কর্মগুণে চির জাগ্রত মহান মরহুম আশেক আলী খান

আজ ২ আগষ্ট চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট, চাঁদপুর-১ (কচুয়া) নির্বাচনী আসনের বর্তমান সাংসদ, সাবেক সফল স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর (এমপি)’র পিতা মরহুম আশেক আলী খান এর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।

মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কচুয়ার গুলবাহার গ্রামে তাঁর নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত আলী খান উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজে কোরআন খতম, মিলাদ, দোয়া ও মোনাজাত এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

দিন ব্যাপী এসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথী হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কচুয়ার গণমানুষের নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর (এমপি)।

এ সময় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সহ প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ উপস্থিত থাকবেন।

মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার কর্মে। কর্মই মানুষকে মহান করে তোলে। নশ্বর এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ যেমনি ক্ষণজন্মা হন, তেমনি কর্মঠ, ত্যাগী আর ব্যতিক্রমধর্মীও হয়ে থাকেন। তাঁরা নিজেদের সুখ ও আরাম-আয়েশের চেয়ে অন্যের উপকার বিশেষ করে নিজ এলাকাবাসীর জন্য কল্যাণকর কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন।

তেমনি একজন মানুষ মরহুম আশেক আলী খান সাহেব। চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে দাদা ও নানার অভিন্ন সংসারে ১৮৯১ সালে তাঁর জন্ম। অমায়িক, বিনয়ী, ধীরস্থির ও ধৈর্যশীল এই মানুষটি চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট। ইংরেজিতে উচ্চ শিক্ষত মরহুম আশেক আলী খান সাহেব তৎসময়ে উচ্চ পদস্থ চাকুরী গ্রহণ এবং সম্পদ অর্জনের বিশাল সুযোগকে গ্রহণ না করে শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিজেকে ব্রত করেন।

দেশের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে তিনি বৃহৎ বাংলার আনাছে-কানাচে ঘুরে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা ও সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক করুণ অবস্থা স্বচক্ষে অবলোকন করেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগোপযোগী সংস্কারের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগের পাশাপাশি তিনি নিজের শ্রম, ধন-সম্পদ দিয়ে কচুয়ায় কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ছেলে-মেয়েদের সুবিধার্থে তাঁরই প্রচেষ্ঠায় কচুয়াতে মাধ্যমিক পরীক্ষার সেন্টার স্থাপিত হয়েছিল।

যে কোন ক্ষেত্রে কার্য মূল্যায়নের জন্য প্রথমেই ব্যক্তি ভূমিকাকে গণ্য করা হয়। এরপর পরিবার, সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠী, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় ভূমিকাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। কার্যটি যাই হোক ব্যক্তি, পরিবার কিংবা অন্যান্যরা কাজটির প্রেক্ষিতে কিরূপ মনোভাব বা আচরণ প্রদর্শন করে সেটাই মূখ্য।

এটাও সত্য যে, ব্যক্তিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের অন্য সব পক্ষ সমূহকে কার্যকর করে তোলা যায়। ব্যক্তির এমন ভূমিকায় যখন একটি সম্মেলিত পারাবারিক ভূমিকা দেখা যায়, তখন একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক পরিবর্তন আবশ্যম্ভাবী হয়। সমাজের উন্নয়নে ব্যক্তি ভূমিকার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও একই লক্ষ্যে সম্মেলিত পারিবারিক ভূমিকার উদাহরণ খুব একটা পাওয়া যায় না।

কিন্তু আমরা কচুয়াবাসী খুবই গর্বিত যে, এমন একটি পরিবার, যার প্রত্যেক সদস্য টেকসই উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার শিক্ষাকে উপজীব্য করে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে নিজেদের জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের সমৃদ্ধির জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করার পাশাপাশি কচুয়াকেও উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই পরিবারটি হল মরহুম আশেক আলী খান সাহেব পরিবার।

সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী, লম্বা, চওড়া, সুদর্শন পুরুষ আশেক আলী খান সাহেব চার ছেলে ও চার মেয়ের জনক। যাদের প্রত্যেকে নিজ যোগ্যতা আর মেধার সমন্বয়ে সমাজের নিবেদিত প্রাণ, শিক্ষাবিদ, গ্রাম প্রেমিক, সমাজ সংস্কারক ও মানব দরদী পিতা, আশেক আলী খান সাহেব এর অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। স্বল্প পরিসরের এ লেখায় উক্ত পরিবারের সবার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে আনা সম্ভব না। তবু দেশ সেরা এই পরিবারটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের জীবন, কর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পাশাপাশি সমৃদ্ধ দেশ এবং উন্নত কচুয়া গঠনে তাদের অবদানের কিছু অংশ তুলে ধরবো।

মরহুম আশেক আলী খান সাহেব এর বড় ছেলে মরহুম মিসবাহ উদ্দিন খান। যিনি সাবেক উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে জনসেবার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করে গিয়েছেন। মরহুম মিসবাহ উদ্দিন খান এর বড় ছেলে ড. মুনতাসীর মামুন।

বিশিষ্ট লেখক, কলামিষ্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত এই মানুষটি আজ দেশের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার পূর্ববর্তী সময়কার প্রকৃত ইতিহাস এ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তিনি তার লেখনি ধারা অব্যাহত রেখেছেন। দেশের ইতিহাস, কৃষ্টি-কালচার নিয়ে রচনা করেছেন বহু গ্রন্থ। দ্বিতীয় ছেলে ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। যার পরিচয় শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসিই নয়।

তিনি একাধারে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকও। তিনি ২০০৯ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে একুশে পদক লাভ করে কচুয়াবাসী হিসেবে আমাদেরকেও সম্মানিত করেছেন। তৃতীয় ছেলে ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। দক্ষিণ এশিয়ার খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত, যিনি পেশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক এবং সরকারের সাবেক সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণিল কর্মময় জীবনের পর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে সরকারের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে চাঁদপুর-১ (কচুয়া) নির্বাচনী আসন থেকে সংদস সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। একসময়কার অনুন্নত, অবহেলিত জনপদ কচুয়ায় আজকের দৃশ্যত উন্নয়নের রূপকার ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর (এমপি)।

দীর্ঘ সময় ধরে কচুয়ার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠমো, কর্মসংস্থানসহ সার্বিক উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখেন, সে জন্য কচুয়াবাসী তাঁর নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। চতুর্থ ছেলে মরহুম ড. হেলাল উদ্দিন খান সামসুল আরেফীন। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ:বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, লেখক ও গবেষক ছিলেন। মরহুম আশেক আলী খান সাহেবের চার মেয়ের প্রথম জন মরহুমা জাহানারা চৌধুরী। যিনি সুশিক্ষিত, সুগৃহিনী ও সংবেদনশীল সমাজকর্মী ছিলেন। দ্বিতীয় মেয়ে মরহুমা মমতাজ ওয়াদুদ। তিনি অতি মেধাবী, লেখক ও চিত্রশিল্পী ছিলেন।

তৃতীয় মেয়ে কোহিনুর বেগম, এক সময়ের সংগীত শিল্পী ও সমাজসেবী ছিলেন। চতুর্থ মেয়ে নীলুফার বেগম। যিনি সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাবেক যুগ্ম-সচিব ও সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাভারে অবস্থিত লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রথম মহিলা এমডিএস।

তাঁর বড় ছেলে ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ্। তিনি কিছু সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

উপরোক্ত বর্ণনার প্রেক্ষিতে, মরহুম আশেক আলী খান সাহেবের সাথে তাঁর উত্তরসূরিদের দু’টি জায়গায় মিল পাওয়া যায। প্রথমটি, পেশাগত মিল। যেখানে পরিবারের অধিকাংশ সদস্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা, গ্রন্থ রচনা, সমসাময়িক বিষয়ে লেখনি দ্বারা কল্যাণমুখী প্রগতিশীল দেশ গঠনে কাজ করছেন। দ্বিতীয়টি, সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ করা। যেখানে পরিবারটির একাধিক সদস্য পূর্বে এবং বর্তমানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কচুয়ার সাধারণ মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। আবার তাদের কেউ কেউ দেশের প্রথম সারির উন্নয়ন সহযোগী সংগঠনের ধারক হিসেবেও কাজ করছেন। যা কচুয়াবাসী হিসেবে আমাদেরকে সত্যি গৌরবান্বিত করেছে। মরহুম আশেক আলী খান সাহেবের চতুর্থ মেয়ে নীলুফার বেগম তাঁর বাবার সেবাধর্মী মানসিকতার কথা এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন- “আমরা ভাই-বোনেরা অধ্যয়নকালীন সময়ে বাবা গ্রামের গরীব ও অসহায় ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা খরচের দায়িত্ব আমাদের উপর দিতেন। তিনি বলতেন, আমরা সবাই যেন ৪-৫ জন করে দরিদ্র শিক্ষার্খীর পড়াশুনার দায়িত্ব নেই। সে সময় আমরাও শিক্ষার্থী ছিলাম। কিন্তু পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশান ও লেখালেখি করে যে আয় করতাম তা বাবার নির্দেশনা অনুযায়ী আমারা গ্রামের ঐসব ছেলে মেয়েদের জন্য খরচ করতাম। বাবার দেখিয়ে যাওয়া পথে আমরা সেবার মানসিকতায় আজও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সাধ্যমত, বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের নামে কচুয়ার মানুষকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকুরীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছি এবং যাবো”।

আত্মকেন্দ্রিকতা ও পুঁজিবাদীর এই যুগে মরহুম আশেক আলী খান সাহেব পরিবারের প্রতিটি সদস্য ভিন্ন মানসিকতা ধারণ করেন। আজও প্রতিনিয়ত তাঁরা তাদের পূর্বসূরীর দেখিয়ে যাওয়া পথে গ্রামের সাধারণ মানুষের সেবায় ছুঁটে আসেন কচুয়ায়। সেবার মানসিকতা, উচ্চ শিক্ষা, পেশাগত উচ্চ অবস্থান ও কল্যাণমুখী চিন্তার গুণে এই পরিবারটি আজ দেশের সেরা পরিবার হিসেবে পরিগণিত। আমরা কচুয়াবাসী বিশ্বাস করি, মরহুম আশেক আলী খান পরিবার দেশের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করার পাশাপাশি কচুয়াকেও উন্নয়ন আর অগ্রগতির দিকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। পরিশেষে, লেখায় সব রকম ত্রæটির জন্য ক্ষমা চেয়ে, মরহুম আশেক আলী খান সাহেরে আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং পরিবারের সকল সদস্যের দীর্ঘায়ু ও সাফল্যমণ্ডিত জীবন কামনা করছি।

লেখক পরিচিতি:
মো. জাহিদ হাসান
শিক্ষক, লেখক ও কলামিষ্ট
মোবাইল: ০১৮১১-১৭৫৭৩০
ই-মেইল: jahidhasan278@yahoo.com

একই রকম খবর

Leave a Comment