ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’, চাঁদপুরে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত

চাঁদপুর খবর রিপোর্ট : অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণী আজ শুক্রবার বাংলাদেশে আঘাত হানবে বলে আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ অতিক্রম করার সময় এটির গতি হবে ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার।

এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ফণী সামান্য উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে।

এটি গতকাল বৃহস্পাতিবার (২ মে) সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১০৬৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১০২৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯১৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯২৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

এটি আরও ঘণীভূত ও উত্তর/উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শুক্রবার বিকাল নাগাদ ভারতের উড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম করতে পারে এবং পরবর্তী সময় উড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে হয়ে শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ খুলনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এলাকায় পৌঁছাতে পারে।

আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, খুলনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় শুক্রবার সকাল নাগাদ অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণী-এর অগ্রবর্তী অংশের প্রভাব শুরু হতে পারে।

‘ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিমির মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৬০ কিমি, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৮০ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।’

তিনি বলেন, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে চার নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

‘উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ সাত নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।’

আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে চার নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ল²ীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতেহ ছয় নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ল²ীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪-৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ¡াসে প্লাবিত হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ল²ীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৯০-১১০ কিমি বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।

উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্বর নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ সাগর থেকে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে বেশ ধীর গতিতে। গতি ধীর হলেও এর মধ্যে ফণী অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। যত সময় যাচ্ছে, ফণী ততই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ফণীর আঘাত বেশ মারাত্মক হতে পারে। ফণীর প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসও হতে পারে। ডুবে যেতে পারে নিম্নাঞ্চল।

জানা যায়, ‘ঘূর্ণিঝড়টি আজ শুক্রবার দুপুরের দিকে ভারতে আঘাত হানার আশঙ্কা বেশি। আজ সকাল থেকে বাংলাদেশে এর প্রভাবে বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাস থাকবে। আজ শুক্রবার (৩ মে) সন্ধ্যায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাবে ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ¡াস হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবেলায় এরই মধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। এনডিআরসি প্রতিনিয়ত সংবাদ দিয়ে যাচ্ছে। সিপিপির (ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি) হেডকোয়ার্টার এবং উপকূলীয় ১৯টি জেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। এসব জেলার উপজেলা পর্যায়েও নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। রেডক্রিসেন্টের নিয়ন্ত্রণকক্ষও খোলা হয়েছে। উপকূলীয় আর্মি স্টেশনগুলোতেও ঢাকা থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তারা প্রস্তুতি রেখেছেন।

সিপিপির ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তারা প্রস্তুত আছেন। স্বেচ্ছাসেবকরা এরই মধ্যে মাইকিং করে প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছেন। মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এসব জেলার প্রশাসকদের কাছে ২০০ মেট্রিকটন চাল পৌঁছে দেওয়া হয়েছে এবং প্রত্যেক জেলা প্রশাসককে ৫ লাখ করে টাকাও দেওয়া হয়েছে। ৪১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। স্যালাইনের জন্য সুপেয় পানির ট্রাক পাঠানো হয়েছে।

এদিকে গতকাল (২ মে) বৃহস্পতিবার বিকালে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে ঘূর্ণিঝড় ফণী মোকাবেলা সংক্রান্ত ত্রাণ ও দূর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. মোঃ এনামুর রহমানের সাথে এক ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ভিডিও কনফারেন্সের পরবর্তী সভায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান বলেন। ঘূর্ণিঝড় ফণী মোকাবেলায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছি। যেকোন দূর্যোগপূর্ণ ঘটনা মোকাবেলা করতে আমরা জেলা এবং প্রতিটি উপজেলায় জরুরী কন্ট্রোলরুম খুলেছি।

তিনি আরো জানান,জেলায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে ৩’শ ১১ টি রয়েছে। তবুও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে প্রয়োজনে জেলার ১ হাজার ১’শ ৫৪ টি প্রাথমিক এবং ২’শ ৯১ টি উচ্চ বিদ্যালয়কে ব্যবহার করা যাবে।

তিনি স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত তথ্যে জানান, জেলায় ১ টি ও উপজেলা গুলোতে ৩ টি এবং ইউনিয়নগুলোতে ১ টি করে মেডিকেল টিমসহ মোট ১’শ ১৭ টি মেডিকেল টীম গঠন করা হয়েছে।

তিনি সেচ্ছাসেবক সংক্রান্ত তথ্যে জানান, দূর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় উদ্ধার অনুসন্ধানের জন্য রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রোভার
স্কাউট, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভলান্টিয়ার সার্ভিস হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

খাদ্য সহায়তা সংক্রান্ত তথ্যে জানান, দূর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নগদ অর্থ ৫ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা, খাদ্যশস্য ৬’শ ২৫
মেট্রিকটন চাল, ৩’শ ৮৩ বান্ডিল ঢেউটিন ও ২ হাজার প্যাকেট খাদ্য সামগ্রীর বরাদ্দ মজুদ পাওয়া গেছে। আমরা এজন্য দুপুরের পর থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার নৌযান বা লঞ্চ বন্ধ রাখা হয়েছে। সকলে মিলে দূর্যোগ মোকাবেলা
করার জন্য জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তাকে কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চাঁদপুর জেলায় রক্ষিত ২ টি উদ্ধারকারী নৌযান সচল রাখা হয়েছে। তাই বলবো এই ঘূর্ণিঝড় ফণি নিয়ে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই।

এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন, চাঁদপুর পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পৌর মেয়র আলহাজ্ব নাছির উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল, সিভিল সার্জন(ভারপ্রাপ্ত) ড. মাহবুবুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল্লা আল মাহমুদ জামান, জেলা স্কাউট সম্পাদক অজয় ভৌমিক, জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা কে বি এম জাকির হোসেন, চাঁদপুর প্রেস ক্লাব সভাপতি শহীদ পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক ল²ণ চন্দ্র সূত্রধর, সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী, জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান, জেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ, জেলা আবহাওয়া কার্যালয়ের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোঃ শামসুল হক প্রমুখ। এ সময় জেলার বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক মহল উপস্থিত ছিলেন।

অপর দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ “ফণী” এর কারণে অস্থায়ী আশ্রয়স্থল হিসেবে সরকার সকল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ব্যবহার করার নির্দেশনা দিয়েছেন চাঁদপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. সফি উদ্দিন।

তিনি চাঁদপুর জেলার সকল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা অস্থায়ী আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রস্তুত রাখার জন্য সকল প্রতিষ্ঠান প্রধানগণকে অনুরোধ করেছেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দপ্তরী/নাইটগার্ডকে চাবিসহ প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

জরুরী প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ রাখবেন। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারগণ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন৷ চাঁদপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মো: শফি উদ্দিন তার ফেসবুক আইডিতে এ তথ্য জানান।

এদিকে চাঁদপুর থেকে সকল লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ঘ‚র্ণিঝড়‘ফনি’ নদী উপক‚লীয় এলাকায় ক্ষতিরআশঙ্কায়। চাঁদপুর-ঢাকা, চাঁদপুর-নারায়নগঞ্জ রূটের সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বিআইডাবিøউ কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার (২ মে) দুপুর ১২টায় বিআইডাবিøউটিএ’র চাঁদপুর বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ঘ‚র্ণিঝড়ে ক্ষতির আশঙ্কায় আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সারাদেশের লঞ্চ ও নৌ-যান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে। বিষয়টি জানতে পেরে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করি এবং চাঁদপুর থেকে সকল নৌ-যান চলচল বন্ধ ঘোষনা করি। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত লঞ্চসহ সকল নৌ-যান চলাচল বন্ধ থাকবে।

তিনি আরো জানান, বন্ধ ঘোষণার প‚র্বে চাঁদপুর থেকে সিডিউল অনুযায়ী যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো ছেড়ে গেছে। কিন্তু দুপুর ১২টার পর থেকে সিডিউলের সকল লঞ্চ বন্ধ রয়েছে।

অপরদিকে ঘুর্ণিঝড় “ফনি’ মোকাবেলায় চাঁদপুর জেলা সদরসহ সকল উপজেলা প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান বলেন, ঘুর্ণিঝড়ের প‚র্ব প্রস্তুতি হিসেবে আমরা প্রশাসনের সকলকে নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছি। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।

একই রকম খবর

Leave a Comment