চাঁদপুর খবর রিপোর্ট : চাঁদপুর জেলার আলোচিত ফরিদগঞ্জের গল্লাক ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ ও কেন্দ্রিয় মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য শাহিন সুলতানা ফেন্সি হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামী স্বামী অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামের দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর এবং এ ঘটনায় দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে কারা গেইটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে । বুধবার চাঁদপুর অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ আদেশ দেন ।
বুধবার (৬ জুন) শেষ বিকেলে মামলার গ্রেফতারকৃত প্রধান আসামী অ্যডভোকেট জহিরুল ইসলাম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে আদালতে হাজির করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির ইন্সেপেক্টর মোঃ মহিউদ্দিন আদালতে উভয় আসামীর ৫ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করলেও বিচারক অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ কায়সার মোশারফ ইউসুফ শুধুমাত্র প্রধান আসামীর ২দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামমলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পুলিশ পরিদর্শক মো. মহিউদ্দিন জানান, ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলেও আদালত প্রধান আসামীর ২দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদেশ কপি পেলেই রিমান্ড কার্যক্রম শুরু করবেন। বর্তমানে উভয় আসামী জেলা কারাগারে রয়েছেন।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার (৫ জুন) শাহিন সুলতানা ফেন্সির ছোট ভাই ফোরকান খান বাদী হয়ে অ্যাডঃ জহিরুল ইসলাম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমেসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দয়ের করেন।
পরে বুধবার (৬ জুন) ৫ দনের রিমান্ডের আবেদন করে বাদী পক্ষ। আদালত এ ঘটনার সাথে জড়িত প্রধান আসামী স্বামী অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামকে দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে কারা গেইটে জিজ্ঞাসাবাদ।
গত সোমবার (৪ জুন) সন্ধ্যার কোনো এক সময় নিজ বাসার ভেতরে খুন হন অধ্যক্ষ ফেন্সি। চাঁদপুর শহরের ষোলঘর এলাকার শেখ বাড়ি রোডে অবস্থিত নিজের চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় এ হত্যাকাÐের ঘটনা ঘটে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গেছে যে, বেড রুমের ভেতরে খাটের পাশে মেঝেতে অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সির রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। আর লাশের আশপাশে ছোপ ছোপ রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
বাবাই আমার মাকে খুন করেছে বলে দাবি করেছেন তার মেয়ে ডা. পুষ্প।
অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সিকে তার স্বামী অ্যাড. জহিরুল ইসলামই খুন করেছে বলে এই দম্পতির ছোট মেয়ে ডা. পুষ্পের দাবি। কুমিল্লা ময়নামতি হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ পুষ্পের সাথে কথা হয় চাঁদপুর মডেল থানার। সাথে তার মামা ফোরকানও ছিলেন।
পুষ্প তার মা হত্যাকাÐের ব্যাপারে বলেন, আমার বাবার দ্বিতীয় বিয়ে করাটাই হচ্ছে কাল। সেই (আমার পিতা অ্যাড. জহিরুল ইসলাম) আমার মাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। সাথে ওই ডাইনীও (তার পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী) ছিলো। সে-ই এই হত্যাকাÐে প্ররোচনা যুগিয়েছে।
পুষ্প একই সময় বলেন, তার চাচা ও ফুফুদের সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে আমার বাবা আমাদের সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন এবং আমাদের তেমন কোনো খোঁজ-খবর রাখতেন না। আমার মায়ের বেতনের টাকা দিয়েই আমাদের পড়াশোনার খরচ মিটতো। আমরা আমাদের মায়ের হত্যার বিচার চাই। এ বলেই পুষ্প হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
লাশের ময়নাতদন্ড করেছে পাঁচ সদস্যের মেডিকেল টিম :
অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সি খুনের ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট নানা দপ্তর। সে লক্ষ্যে নিহতের লাশের ময়না তদন্তের জন্যে পাঁচ সদস্যের মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমের সদস্যগণ হচ্ছেন আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের সার্জারী বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম, দুই আরএমও ডা. হাসিবুল হাসান ও ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল এবং মেডিকেল অফিসার ডাঃ তাবেন্দা ও ডাঃ নাসরিন পারভিন।
গত মঙ্গলবার সকালেই মেডিকেল টিম ময়না তদন্তের কাজ সম্পন্ন করেন। সূত্র থেকে জানা গেছে, নিহতের মাথার পেছনে ডান সাইডে প্রচÐ আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আর এই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েই তার মৃত্যু হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে। তারপরও এই ময়না তদন্ত রিপোর্ট শতভাগ স্বচ্ছ এবং সুস্পষ্ট করার লক্ষ্যে ভিসেরা রিপোর্টের জন্যে নিহতের কিডনী, লিভার ও পাকস্থলী ঢাকার মহাখালীস্থ সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
আর মামলার ক্ষেত্রে সর্বাধিক স্বচ্ছতার লক্ষ্যে নিহতের ডিএনএ টেস্টের জন্যে তার নখ ও চুল ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
মামলার তদন্ত ডিবি পুলিশের উপর :
চাঁদপুর পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম, এর নির্দেশে চাঁদপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী ও কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য অধ্যক্ষ শাহিনা সুলতানা ফেন্সি খুনের ঘটনায় চাঁদপুর মডেল থানায় মঙ্গলবার মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং ১০, তারিখ ৫/৬/২০১৮ খ্রিঃ। মামলার ধারা উল্লেখ করা হয়েছে দÐবিধির ৩০২/৩৪/১০৯ ধারা। মামলার বাদী হচ্ছেন নিহত অধ্যক্ষ ফেন্সির ভাই ফোরকান উদ্দিন খান।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে চাঁদপুর ডিবি পুলিশের উপর। ডিবির ইন্সপেক্টর মহিউদ্দিন হচ্ছেন এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। বুধবার (৬ জুন) আটক দুই আসামী অ্যাডঃ জহির ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড দেয়া হয়েছে।
অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামকে পুলিশের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। স্ত্রী অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সি খুনের ঘটনায় আটক তার স্বামী অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামকে চাঁদপুর মডেল থানায় দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও পিবিআই মঙ্গলবার সকাল থেকে পৃথক পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে অ্যাডঃ জহিরকে।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে চাঁদপুর মডেল থানা কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় একটি রুমে অ্যাডঃ জহিরকে বসিয়ে তার সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন, চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মোঃ মিজানুর রমান।
এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) তাহমিদুল ইসলাম ও ডিবি পুলিশের অফিসার ইনচার্জ নূরে আলম মামুন। এছাড়া এর আগে-পরে ডিবি পুলিশ এবং পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) অ্যাডঃ জহিরকে পৃথক পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে কোনো কিছু জানা যায়নি।
অধ্যক্ষ ফিন্সি হত্যার তদন্ত কর্মকর্তা ও চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ইন্সেপেক্টর মহিউদ্দিন বুধবার রাতে দৈনিক চাঁদপুর খবরকে জানান, হত্যার ঘটনায় ফেন্সির ছোট ভাই ফোরকান বাদী হয়ে মামলা দায়ের করা হলে মামলার দতন্ত করার জন্যে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বুধবার আদালতে নথি দাখিল করলে ৫ দিনের রিমান্ড দাবি করে বাদী পক্ষ। পরে দু’দিনে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
তিনি আরো বলেন,এ ঘটনার প্রধান আসামী স্বামী অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামকে দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে কারা গেইটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
অধ্যক্ষ ফেন্সি হত্যার দু’দিন পরে বুধবার (৬ জুন) দু’দফা জানাজা শেষে তার নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়। তার প্রথম জানাজা চাঁদপুর সদর উপজেলার খলিশাডুলী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় জানাজা রাত ১০টায় সদর উপজেলার মৈশাদী বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয়।
এ ঘটনায় নিহত ফেন্সির বাড়িতে স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের ভিড় ও সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে।
নিহত কলেজ অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সির পৈত্রিক বাড়ি চাঁদপুর পৌরসভার ১৩নং ওয়ার্ডস্থ বাহের খলিশাডুলি গ্রামে নিহতের আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের গত দু’দিন ভিড় করতে দেখা দেছে। সর্বত্র যেনো শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সে বাড়িতে এসে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সকলেই যেনো শোকার্ত ছিলো।
নিহত ফেন্সির লাশ মঙ্গলবার সকালে ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরের দিকে তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হিমায়িত লাশবাহী গাড়িতে নিহত ফেন্সির মরদেহ রাখা হয়। পরে বুধবার তাঁর বড় মেয়ে ইতালি থেকে আসার পর রাত ১০টায় জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।