…………………………………… ড. মোহাম্মদ হাসান খান…………………………….
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তিনি শেখ লুৎফর রহমান। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন লুৎফর রহমানের মত আদর্শ বাবা এবং সায়েরা খাতুনের মত আদর্শ মা পেয়েছেন বলেই।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সকল প্রকার আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর বাবা-মায়ের জোরালো সমর্থন ছিল। বাবা লুৎফর রহমান তাঁদের আদরের খোকাকে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সহযোগিতা করে গেছেন সবসময়।
শেখ লুৎফর রহমানের পূর্বপুরুষবৃন্দ ইরাক থেকে এ দেশে আসেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে। তাঁর বাবার শেখ আবদুল হামিদ। পূর্বপুরুষদের মত তিনিও ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।
শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ আদালতে সেরেস্তাদারের কাজ করতেন। তিনি যৌবনে তাঁর ভাই, বোনদের দায়িত্ব কাঁধে নেন। শেখ মুজিবুর রহমান মেট্রিক পাশের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যাওয়ার দিনই শেখ লুৎফর রহমান চাকুরি থেকে অবসর নেন। গ্রামের সকলেই তাঁকে মান্য করত। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসী ছিলেন বলে মুসলমানরা তো বটেই, হিন্দু ও অন্য ধর্মের লোকজনও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের ১৩তম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সকলেই আমার আব্বাকে সম্মান করতেন।’
শৈশবে শেখ মুজিব ছিলেন ভীষণ বাবাভক্ত ছেলে। তিনি বাবার আশেপাশে থাকতে ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসত না।’ শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে জানতে পারি, শেখ লুৎফর রহমান খেলাধুলা পছন্দ করতেন, নিজে ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি স্থানীয় অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুরও খেলাধুলায় ঝোঁক থাকার কারণে মাঝে মাঝে তাঁর বাবার টিমের সাথে তাঁদের খেলা পড়ত। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম আর আমার টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত।’
শেখ মুজিব রহমান ছোটবেলা থেকে সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ, বেদনা নিয়ে ভাবতেন। অসহায় গরিবদের সাধ্যমত সহযোগিতা করতেন। গায়ের চাদর দিয়ে, ক্ষুধার্তকে খাবার দিয়ে তাঁর সাধারণ অসহায় মানুষদের পাশে থাকার অসংখ্য নজির রয়েছে। শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন ছেলের কর্মকাÐে খুশি হতেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে তাঁর দাদা-দাদি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘আমার দাদা-দাদি অত্যন্ত উদার প্রকৃতির ছিলেন। আমার আব্বা যখন কাউকে কিছু দান করতেন তখন কোনোদিনই বকাঝকা করতেন না বরং উৎসাহ দিতেন। আমার দাদা ও দাদির এই উদারতার আরও অনেক নজির রয়েছে।’’
শেখ লুৎফর রহমান সংস্কৃতিমনা ছিলেন। পত্রপত্রিকা পড়তে পছন্দ করতেন বলে নিয়মিত খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, আজাদ, বসুমতি, মোহাম্মদী, সওগাত পত্রিকা পড়তেন তিনি। তাঁর দেখাদেখি শেখ মুজিব শৈশব থেকে পত্রিকা পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
আমরা জানি, শেখ মুজিব জীবনের তিনভাগের একভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে কোন জেলে রাখা হয়েছে তা অনেকসময় সহজে জানা যেত না। তখন শেখ লুৎফর রহমান ছেলের খোঁজখবর নিতে ছুটে বেড়াতেন এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে। পুত্রের অনিশ্চিত জীবন জানা সত্তে¡ও বঙ্গবন্ধুকে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতে কখনো বলেননি। উল্টো তিনি শেখ মুজিবের পাশে থেকেছেন এবং সাহস যোগাতেন। শেখ মুজিব জেলে গেলে তিনি তাঁকে টাকা পাঠাতেন নিয়মিত, তিনি ছেলের জন্য সবসময় কি খেলো না খেলো, শরীরটা শেখ মুজিবরের কেমন যাচ্ছে কিংবা কারাগারে কি রকম কষ্ট দিচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তায় থাকতেন।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে।’ বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেন, এ নিয়ে মানুষের মাথাব্যথার শেষ ছিল না। কেউ কেউ বিচার দিত বাবা শেখ লুৎফর রহমানের কাছে। একবার কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁকে হুশিয়ারি করে বলেছেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে সে জেল খাটবে, তার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। ঐ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সেইদিন এক ঐতিহাসিক জবাব দিয়েছিলেন বাবা শেখ লুৎফর রহমান। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না।’’ এমনই দেশপ্রেমিক পিতা ছিলেন শেখ লুৎফর রহমান। তাঁর বলিষ্ঠ অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনীতি করতে পেরেছিলেন।
অল্পবয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা শেখ পরিবারে বড় হয়েছেন। শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন তাঁকে মেয়ের মত করে সংসারে স্থান দিয়েছেন। অপরদিকে সংসারের বড় ছেলে হয়েও বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করে বেড়িয়েছেন, সংসার সামলানোর কাজ করে গেছেন শেখ লুৎফর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘‘আমি তো আব্বার বড় ছেলে। আমি তো কিছুই বুঝি না, কিছুই জানি না সংসারের। কত কথা মনে পড়ল, কত আঘাত আব্বাকে দিয়েছি, তবু কোনোদিন কিছুই বলেন নাই, আমার বাবা একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। সকলের পিতাই সকল ছেলেকে ভালবাসে এবং ছেলেরাও পিতাকে ভালবাসে ও ভক্তি করে। কিন্তু আমার পিতার যে ¯েœহ আমি পেয়েছি, আর আমি তাঁকে কত যে ভালবাসি সে কথা প্রকাশ করতে পারব না।’’
বাবা হিসেবে শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন শেখ মুজিবের মাথার ওপর বটবৃক্ষ। পিতা হিসেবে তিনি যথার্থই শেখ মুজিবকে বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।
পিতা হিসেবে শেখ মুজিবকে নিয়ে শেখ লুৎফর রহমান গর্বিত বোধ করতেন। স্বাধীনতার পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘শেখ মুজিব সৎসাহসী ছিল। উদ্দেশ্য তার সবসময় নেক উদ্দেশ্য ছিল।….গরিবের প্রতি ছোটবেলা থেকে তার খুব দয়া ছিল। ….সে যেখানেই যেত সেখানেই নেতৃত্ব দিত।’ শেখ মুজিবকে শৈশবে তাঁর পিতামাতা ‘খোকা’ বলে ডাকতেন।
শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে তিনি হয়েছেন বাঙ্গালি জাতির জনক, তখনও তিনি শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের কাছে আদরের ‘খোকা’ই ছিলেন। আবার আজকের বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনারও শৈশব কেটেছে দাদা-দাদির সাথে। তাঁদের আদর যতেœ টুঙ্গিপাড়ায় বেড়ে উঠেন অতিআদরের নাতনি হাসু হিসেবে।
সেই নাতনি শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের চার বারের প্রধানমন্ত্রী, দেশকে ছাড়িয়ে আজ পৃথিবীর ইতিহাসে শেখ লুৎফর রহমানের নাতনি শেখ হাসিনা পৃথিবীর দ্বিতীয় সৎ প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে এক ইতিহাস হিসেবে নিয়ে গেছেন, বাংলাদেশ এখন বিশে^ রোলমডেল, আমাদের মহান সৃষ্টকর্তার কাছে প্রর্থনা থাকবে শেখ লুৎফর রহমানের নাতনি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা যেন দীর্ঘজীবি হন এবং আমৃত্যু প্রধানমন্ত্রী থাকেন।
শেখ লুৎফর রহমান আজীবন সাদামাটা জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি জীবত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও পরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনি বঙ্গভবনে থাকতেন না, বরং গ্রামেই সাধারণের মত জীবনযাপন করতেন। এত সাদামাটা জীবনযাপন আর কোন প্রধানমন্ত্রীর বাবা করেছেন বলে আমার জানা নেই।
শেখ লুৎফর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৯ মার্চ ইন্তেকাল করেন। তাঁকে নিজ গ্রাম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করা হয়। তাঁর নামে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিবছর আওয়ামী লীগ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন। আর যতদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন, ততদিন কৃতজ্ঞতার সাথে জাতি স্মরণ করবে এই মহৎপ্রান পিতা, শেখ লুৎফর রহমানকে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : ড. মোহাম্মদ হাসান খান, সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর জেলা।