আমরা একজন বঙ্গবন্ধুকে জানি, যিনি কেবল একটি নাম নয়, বরং নিজেই একটি ইতিহাস । যাকে বাঙ্গালী জাতি সহ বিশ^বাসী ভালোবাসে ও সম্মান করে।
যার একটি অঙ্গুলি হেলনে হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করে। প্রশাসনে না থেকেও যার কথায় সুপ্রিমকোর্ট বন্ধ হয়ে যায়, সারাদেশ স্থবির হয়ে যায়। যার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন একটি ভু-খÐ পেয়েছি। তিনি কেবল একজন সফল রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি সফল মানুষও ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাই নন, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি। তাঁকে নিয়ে দেশে বিদেশী অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, প্রচুর ডকুমেন্টরি প্রচার করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ মানেই একজন বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। এই মহামানবের সফলতার নেপথ্যে ছিলেন এক মহিয়সী নারী।
তাঁর কথা ইতিহাসে ওইভাবে বলা হয়নি। অথচ তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে বাঙালির জন্যে নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে গেছেন। এই মহিয়সী নারীর নাম বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
তিঁনি আমাদের বঙ্গমাতা। আজ এই মহিয়সী নারীর ৮৮তম জন্মদিন। দেশ, জাতি ও বঙ্গবন্ধুর জন্য তাঁর অবদানের কিছু কথা তুলে ধরে আমি সামান্য কিছু ঋন পরিশোধের চেষ্টা করছি।
বেগম ফজিলাতুন্নেছার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। তিনি বঙ্গবন্ধুর গ্রাম গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফজিলাতুন্নেছা মাত্র তিন বছর বয়সে তাঁর পিতা শেখ জহুরুল ইসলাম এবং পাঁচবছর বয়সে তাঁর মা হোসনেয়ারা বেগমকে হারান।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধু যতটা না ঘরের মানুষ ছিলেন, তারচেয়ে বেশি ছিলেন সাধারণ মানুষের। সেজন্য বিয়ের পর আর দশজন সাধারণ নারীর মত স্বামীকে কাছে পাননি। বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে।
অন্যদিকে তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি জেলে জেলে কাটিয়েছেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিল না। কখনো তাঁর কোনো কথাবার্তায় বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায়নি।
বরং তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুর পাশে ছায়ার মতো ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবকে কখনও সংসারের ঝামেলায় জড়াতেন না। সংসার, সন্তান, সবকিছুই তিনি একা সামলাতেন। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার কারণে বহু ঈদ তিনি বিসর্জন দিয়েছেন।
কিন্তু সন্তানদের তিনি কখনও পিতার অভাব বুঝতে দেননি। ছেলেমেয়েদের তিনি বোঝাতেন তার বাবা বাংলার মানুষের স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন করছে। বাংলাদেশের সবার জন্য তাঁকে ভাবতে হয়। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি রাজপথকে বেছে নিয়েছিলেন।
তাই আর দশজন বাবার মতো সন্তানরা তাঁকে কাছে পাবে না। সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরেছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুকে তাই পরিবার নিয়ে বেশি ভাবতে হয়নি। সেকারণে তিনি পরিবারের স্বাভাবিক বাঁধন ছাড়াই আজীবন রাজনীতি করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় সংসার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘রেণু বলল, ‘(সংসার নিয়ে) চিন্তা তোমার করতে হবে না। ‘সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি’।’’ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিও করেছিলেন ফজিলাতুন্নেছা। তিনি হাউজ বিল্ডিং-এর লোন নিয়ে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন।
নিঃসন্দেহে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর পাশেই ছিলেন না, তিনি দুঃসময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। দলের কাছে তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এমনকি দলের জন্য নিজের গহনা বিক্রি করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। এমনকি সংসারের বাজার হাটের টাকা থেকেও তিনি প্রয়োজনে দলীয় নেতাকর্মীদের টাকা দিতেন। ৭৫-এর অন্যতম ঘাতক মেজর ডালিমকেও তিনি ব্যবসা করতে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। এরপর তিনি কিছুদিন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেন। তিনি বড় বড় ধরনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত।
তিনি জানতেন তাঁকে কিভাবে চলতে হবে। তিনি তাঁর সন্তানদের আজীবন সাধারণ জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত এক আবহমান বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। প্রধানমন্ত্রী হয়েও শেখ হাসিনা সন্তান জয়ের জন্য খাবার রান্না করছেন, এ দৃশ্যটি ফজিলাতুন্নেছা মুজিবেরই প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন ‘ব্রাটান্ড রাসেল’।
তিনি ব্রাটান্ড রাসেলের জীবনদর্শন অনুসরণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ‘ব্রাটান্ড রাসেল’-এর কথা শুনতে শুনতে ফজিলাতুন্নেছা নিজেও লেখকের ভক্ত হয়ে গেলেন। তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন ’রাসেল’! এ থেকেই বুঝা যায় তার একটি জ্ঞান পিপাসু মন ছিল।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর মায়ের মত জ্ঞান পিপাসু । তিঁনি বই মেলায় যান, বই পড়েন এবং বই লিখেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা ”বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বৈরাচারের অভ্যুত্থান” এই বইটি তদানিন্তন সময়ে রাজনৈতিক লেখার ভিতরে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
বঙ্গমাতা, বঙ্গবন্ধুর মতো অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও তাঁর কোনো চাহিদা ছিলো না। তিনি তখনও আর দশজন বাঙ্গালী নারীর মতই স্বামী-সন্তানদের জন্যে নিজের হাতে রান্না করতেন। পোশাক, অলঙ্কার নিয়ে বিলাসিতা দূরের কথা, তিনি সাধারণ চাকচিক্যও পছন্দ করতেন না।
তিনি গায়ে গহনাও পরতেন না। অথচ এটি আজকের বিশে^ কোনো রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর বেলায় এ কথা চিন্তাই করা যায় না। বঙ্গবন্ধু এদেশের রাষ্ট্রপ্রতি হয়েও বঙ্গভবনে থাকতেন না। তিনি ছিলেন ইতিহাসে মÐিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কোনো রকম রাষ্ট্রীয় প্রটৌকল চাইতেন না।
এত বিলাসবর্জিত জীবন আর কোন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী যাপন করেছেন কিনা সন্দেহ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যারা রাজনীতি করতো, এমনকি যারা বঙ্গবন্ধুর গঠনমূলক সমালোচনা করতেন, তারাও একবাক্যে বঙ্গমাতার সাধারণ জীবনযাপনের কথা স্বীকার করবেন।
আজীবন নিভৃতচারী এই নারী বঙ্গবন্ধুর সকল সংগ্রামে পাশে থেকেছেন। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী নন, জীবন সঙ্গীনিও। তিনি আজীবন তাঁর স্বামীর আদর্শকে লালন করে গেছেন। তাই নিয়তিও যেন মৃত্যুক্ষণটি একদিনে একই সময়ে লিখে দিলো।
বঙ্গবন্ধু বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে ডাকতেন রেণু বলে। আজ এই মহামানবীর জন্মদিনে তাঁকে নতুন করে শ্রদ্ধা জানানোর কিছু নেই। কারণ ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুদিন থাকে না, প্রতিদিনই তাঁদের জন্মদিন।
লেখক : অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ হাসান খান; সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর জেলা।
E-mail : mhk381975@gmail.com
Mobile : 01713007787
Please Published 08 August 2018