মতলব উত্তরে এতিমখানার ছাদ ধসে অর্ধশত ছাত্র আহত

চাঁদপুর খবর রিপোর্ট : চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজিকান্দি কমপ্লেক্সের আল-আমিন এতিমখানার পরিত্যাক্ত ভবনের ছাদ ধসে শনিবার (২৩ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১১টায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

দুই উপজেলার ফায়ার সার্ভিসের দুটি টিমসহ এলাকার শত শত মানুষ উদ্ধার কাজে অংশ গ্রহণ করেন। আহতদের মধ্যে মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে প্রায় ৫৫ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ১২জন। গুরুতর আহত একজন শিশু শিক্ষার্থীকে ঢাকা রেফার করা হয়েছে। ঘটনার খবর পেয়ে চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-দক্ষিণ) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. নুরুল আমিন রুহুল এমপি, চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান, দুই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

শনিবার (২৩ নভেম্বর) দিনগত রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে পরিত্যাক্ত ৪তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছাদে শিক্ষককের সাথে শতাধিক শিক্ষার্থী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ বিষয়ে একত্রিত হলে দুর্ঘটনার শিকার হয়। একত্রিত হওয়া শিক্ষার্থীরাসহ ছাদের মাঝখানের অংশ ধসে নিচে পড়ে যায়। এই সময় ওই স্থানে থাকা প্রায় ৬০জন শিক্ষার্থী কম-বেশী আহত হয়।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এতিম শিক্ষার্থীরা হলেন : সিহাব (১৪), আইনুদ্দিন (১৩), নাহিদ (১৩), সাব্বির (১৩), ইব্রাহীম (১৩), তরিকুল ইসলাম (১৩), আব্দুল আজিজ (১৩), সজিব (১৫), আব্দুল্লাহ (১৪), রহমান (১৫), নাহিদ (১৪) ও সিনিয়র সহকারী মৌলভী মোহাম্মদ হোসেন (৫০)। ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নেয়া শিশুর নাম হচ্ছে সিয়াম (১০)। মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আরিফ হোসেন (১৪), মোঃ আজহার (১৫), মোঃ আহম্মদ আলী (১০), মোঃ হাবিবুব রহমান (১৩), মোঃ আকরাম (১৫), মোঃ তামিম (১৩), মোঃ সুজন (১৪). মোঃ শাখাওয়াত (১৫), মোঃ রাকিব (১৪)।

রাত ২টায় মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকা ওই মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আহম্মদ উল্যাহ বলেন, মতলব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২৫জন। এর মধ্যে ৯জন ছাড়া বাকিদের চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ও ৩জন চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। ফরাজিকান্দি কমপ্লেক্সের মহিলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. শহীদ উল্যাহ বলেন, এতিমখানার সকল ছাত্রদের মাদ্রাসার আভ্যন্তরনী পরীক্ষা শেষ হয় শনিবারে। পরদিন রোববারে ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষ্যে প্রস্তুতির জন্য কাউকে ছুটি দেয়া হয়নি। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সকলকে কথা বলার জন্য ডেকে আনা হয় ঘটনাস্থলে।

একত্রিত হলেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শিক্ষার্থীরা। ঘটনার পরেই স্থানীয়দের ও মাদ্রাসার অন্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় আহতদের মতলব উত্তর উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় ১৭জন। এছাড়াও কিছু আহত ছাত্র আনন্দ বাজার ও ছেঙ্গারচর বাজারে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়।

ফরাজিকান্দি আলিয়া মাদ্রাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. মাসুদ বলেন, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ফরাজীকান্দি আল-আমিন এতিমখানা থেকে একটি টিম জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে, একটি টিম চাঁদপুর জেলা স্টেডিয়ামে এবং একটি টিম মতলব উত্তর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করতে পাঠানো হয়। সেই কারণে টিম লিডার (শিক্ষক) মোহাম্মদ হোসেন সেই এতিমখানার কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে টিমের তালিকা তৈরী করছিলেন। এমতাবস্থায় এতিমখানার বর্ধিত অংশের দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ে।

এই ঘটনার সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার। তিনি পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে আহত শিশুদের চিকিৎসার তদারকি করেন। একই ভাবে মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা হক। চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ শওকত ওসমান বলেন, ঘটনার পরেই আমরা ৩ হাসপাতাল ও ঘটনাস্থলের সাথে সার্বিক যোগাযোগ রক্ষা করেছি। ঘটনাস্থলের ওই ভবনটি পূর্ব থেকেই পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। রাত ১২টার পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে মতলব উত্তর ফরাজিকান্দি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান বলেন, ঘটনাস্থলসহ সকল আহতদের সাথে কথা বলা হয়েছে। তারা এখন ভাল আছে। যারা গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। আমরা সকলে আহত শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসার খোঁজ খবর রাখছি।
এদিকে রোববার (২৪ নভেম্বর) চাঁদপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট নুরুল আমিন রুহুল ঘটনাস্থল, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে ছুটে যান।

আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। সবধরনের চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শংকর কুমার সাহাকে। দ্রুত এ মাদরাসা ও এতিমখানার জন্য ভবন চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির দৃষিট আকর্ষণ করে সংসদ সদস্য নুরুল আমিন রুহুল। এ মাদরাসায় প্রায় ৫শ’ শিক্ষার্থীসহ ২শ’ এতিম রয়েছে। রাতেই চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান পিপিএম, ইউএনও শারমিন আক্তার, সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার (মতলব সার্কেল) আহসান হাবীব, সহকারি কমিশনার (ভূমি) আনোয়ার হোসাইন পাটোয়ারী, মতলব উত্তর থানার ওসি মো. নাসির উদ্দিন মৃধা, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুরশেদুল আলম ভূঁইয়া।

ফরাজীকান্দি দরবার শরীফের পীরজাদা আল্লামা মাসউদ আহমদ জানান, এই ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ তিন তলা ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সেখানে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। আল আমিন এতিমখানার আবাসিক কর্মকর্তা শাহান শাহ সেলিম জানান, মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজীকান্দি উয়েসিয়া কামিল মাদ্রাসার এতিমখানার ছাত্ররা ১৬ ডিসেম্বর চাঁদপুর জেলা স্টেডিয়ামে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে শনিবার রাতে শিক্ষকদের সাথে সভা করছিল। রাত ১১টায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওজন সইতে না পেরে তিন তলা বিশিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় তলা বারান্দার ফ্লোর ধসে পড়ে।

এতে দ্বিতীয় তলায় থাকা শিক্ষার্থীরা নিচতলায় পড়ে গুরুতর আহত হয়। নতুন ভবন নির্মাণে সহযোগিতার জন্য আমরা বিভিন্ন সময় প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কিন্তু তা না পাওয়ায় আমাদের এই ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র ও এলাকাবাসীর সহায়তায় আহত ছাত্রদের উদ্ধার করে। পরবর্তীতে খবর পেয়ে চাঁদপুর থেকে দমকল কর্মী, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়।

চাঁদপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খবর পেয়ে আমরা রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভবন নির্মাণে কোনো ধরনের নিয়মনীতি ছিল না। বসবাসের অনুপযোগী ৩তলা ভবনটিতে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হবে। মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, দুর্ঘটনার খবর জানার পরপরই আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আহত শিক্ষার্থীদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হচ্ছে। দুর্ঘটনার শিকার তিনতলা ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।

চাঁদপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট নুরুল আমিন রুহুল বলেন, মাদরাসাটি এ অঞ্চলের প্রাচীন ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতিমখানার ভবনটি ঝরাজীর্ণ ছিল। এ স্থানে সরকারী ভাবে ভবন করার জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া এতিমদেরজন্য অস্থায়ী ভাবে টিনসেট করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১০ বান্ডিল ঢেউটিন, ৩০ হাজার টাকা ও ৫০টি কম্বল দেয়া হয়েছে।

একই রকম খবর