মাদকের কাছে অসহায় গৃহবধুরা

…………………………………………….: মনিরুজ্জামান বাবলু :…………………………………..

ছোট্ট শিশু তার বাবার কোলে। মা পাশে দাঁড়িয়ে। তিনজনের হাস্যজ্বল ছবি। একটি ছোট সংসার। এই ছবিটি এখন শুধুই কল্পনা। বাস্তবতা পুড়ে গেল কেরসিন আর দিয়াশলাইয়ের আগুনে। ছবিতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে ছোট্ট সন্তানের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মারলো বাবা।

তিনজন এখন তিন প্রান্তে। মা পরপারে। বাবা কারাগারে। আর মামার কোলে ঠাঁই হয়েছে ছোট্ট শিশুর। তিনজনের এই ছোট সংসারটি পুড়ে চারখার হয়ে গেল। যেন, ছবিটি পুড়ে গেছে। বলছিলাম অগ্নিদগ্ধে নিহত দিপিকা আচার্য্য মণিকার কথা।

মণিকার স্বামী বিপুল আচার্য্য। বিপুলের পরিবার বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক। তা দেখে নরসিংদী কেন, আরো দুরত্ব হলেও মণিকার মতো অন্য পরিবারের কন্যাকেও বিয়ে দিবে। বিবাহ বিধাতার বিধান। কিন্তু প্রতিটি পরিবাবারে পেশা আর নৈতিকতা কতটুকু বিবেচনা করতে সময়ক্ষেপন করতে হয়। মণিকার বেলায় তাই হয়েছে। যখন মণিকা লাশ হয়ে বাবার বাড়ী ফিরেছে। তখন সবাই প্রতিবাদী হতে চায়।

আমরা দেখেছি, নুসরাতের গায়ে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে কেরোসিন ঢেলে দিয়াশলাই ছুঁড়ে দিতে ভয় হয়নি কয়েক তরুণ-তরুণীর। ঘটনার শেষে অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে দেখে-জেনে সারাদেশ ভূমি কম্পের মতো কেঁপেছে।

কলামিষ্ট ও অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যার নুসরাতকে ‘প্রিয় নুসরাত’ বলে সম্বোধন করেছে। সত্যিই নুসরাত প্রিয়। সেই দীর্ঘ বিশ বছরের মোড়লের ধৃৃষ্টতা জাতিকে দেখিয়ে দিয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কবরে নুসরাতের দেহে গেছে। প্রাণটা ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কুকর্মের জন্য প্রতিবাদ করবে চিরজীবন।

গৃহবধুরা বিয়ের পর স্বামীর আশ্রয়স্থলে আগুন নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগুনের তাপে খাবার রান্না করে স্বামী-সন্তানদের মুখে তুলে দিতে অপেক্ষমান থাকতে হয়। সেই স্বামী যদি আগুন হাতে নিয়ে স্ত্রীর গায়ে ধরিয়ে দেয়, তাহলে দগ্ধ অবস্থায় স্ত্রী ওই স্বামীর দিকে চেয়ে চেয়ে হয়তো শ্রষ্টার কাছে অভিশাপ দিবে। কিন্তু মণিকার সন্তান কাকে মা ডাকবে? তার সন্তানের নামর পূর্বে শুরু হয়ে গেল হতবাগা সন্তান!

ডাকাতিয়ার পাড়ের হাজীর বাজারে অগ্নিদগ্ধে শুধু মণিকা নয়, আরো কয়েক মণিকা পুড়েছে। দৃষ্টান্তমুলক কোন সাজা হয়নি। সব মণিকাদের স্বামী মাদকাসক্ত। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথচ হাজির বাজারে সবচেয়ে মাদকের মামলা বেশি। ক্রসফায়ার নামক অভিযান জনস্বার্থে জনপ্রত্যাশার সিকি পরিমাণও হয়নি। মণিকাকে যেই ভবনে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ওই ভবনে তিনবার যেতে চেয়েও পারিনি। তালাবদ্ধ এখন ওই ভবন। জেনেছি, মণিকার কক্ষের দেয়ালে মাথার রক্তের দাগ আছে। আগুন লাগানোর পূর্বে মণিকাকে আঘাত করে স্বামী বিপুল। একটি গোয়াল ঘরের চেয়েও ছোট মণিকার স্বামীর বাসভবন। যত অর্থ সম্পদ ছিল সবই গেছে সর্বগ্রাসী মাদকের ছোবলে। ভবনের ইতিবৃত্ত জানতে গিয়ে হতবাক হলাম।

ওই ভবনের দ্বিতীয় তলা চয়নিকা স্টুডিও। সেখানে বিপুল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত। ওই স্টুডিতে বছরে একজন কাস্টমার যায় কিনা আমার সন্দেহ হয়। আবার সন্দেহ ভেঙ্গেছে এটিতো স্টুডিও শুধু মাত্র সাইনবোর্ড।

অন্তরালে মাদক দ্রব্য ইয়াবা সেবনের নিরাপদ ঠিকানা। বিপুলকে বিপুলের পরিবার পারেনি মাদক থেকে ফেরাতে। স্ত্রী হিসেবে মণিকাও চেষ্টা করেছে প্রায় দশ বছর। পারেনি, মাদকাসক্ত স্বামীর দেয়া অগ্নিশিখার কাছে হেরে গেছে।

মণিকার মতো হাজীর বাজারের এমন লোমহর্ষক ঘটনা আরো ঘটেছে। কাপড়িয়া পট্টিতে ধর্ণাঢ্য বাবার আদরের সন্তানের হাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে এক গৃহবধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তৎকালীন ক্ষমতার দাপুটেপনার কাছেও বিচার কার্যক্রম ভেস্তে গেছে। ওই গৃহবধুর নাম মনে পড়ছে না। ধরে নিন রিতী।

মণিকা আর রিতীর অগ্নিদগ্ধের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। দুইটি ঘটনার শুরুতে সবাই জেনেছে চুলায় দুধ গরম করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ গৃহবধুরা। কত বড় লোকের পরিবার। রাত ২ টা/ ৩টার দিকে দুধ গরম করতে যায় গৃহবধুরা। সমাজ নাকি তাদের ওই পাতানো তথ্য লুপে নিবে? দুধ গরম করতে গিয়ে শুধু পথে কাঁটা পুড়বে? পরিবারের বাকীরা পোড়া দৃশ্য দেখবে? আপনজন হয়ে যাদের স্থলে আসা তারা কত নিষ্ঠুর হতে পারে একবার ভাবুনতো।

এদিকে কান্নার বিলাপ ধরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বলবে, ঘর-বাড়ী পুড়ে গেছে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। সমাজে এখন তাদের সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসার প্রবণতা বেড়েছে। যদি কোন দেহ পুড়ে যায়, দায়িত্বটা পুলিশের উপর শতভাগ বর্তায়। সেই পুলিশ হেরফের করলে ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার মতো হবে।

আমরা দেখেছি মণিকা হত্যার পর পুলিশের অতন্দ্রীপ্রহরীর মতো সুযোগ-বুঝে নির্দয় ওই হত্যাকারী বিপুলকে গ্রেফতার করেছে। শুধু বিপুল নয়, তার মা ও ভাইকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়। রিমান্ড চেয়েছে। পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মনিটরিং করছেন। পুলিশের কাজের-কাজ চার্জশীট। আমরা চার্জশীটে বস্তুনিষ্টতা চাই। আমরা আদালতের মাধ্যমে মণিকা হত্যার দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি চাই।

আমাদের চাওয়া আরো আছে, মণিকা ও নুসরাত হত্যাকারীদের যেভাবে আইনী কার্যক্রম চলছে। সেভাবে রিতীর মতো আরো অনেকের হত্যাকারীরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা ঘুরে বেড়ায় মাদক হাতে। মাদক তাদের বড় শক্তি। ওই শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আরো অনেক রিতীকে পুড়ে মরতে হবে। বিচার ব্যবস্থা দেখবে না জনগণ। ওদেও প্রতি প্রশাসনের নজরধারী বাড়াতে হবে।

হাজীর বাজারে উঠতি বয়সী রাজনীতিপনা তরুণ-কিশোরা কেন মাদকে ঝুঁকছে? সেইসব নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের টিম মাস্তি সংগঠনে একঝাঁক তরুণ। তারা ঝুঁকেছে সমাজে আলো ছড়ানোর কাজে। বেশ করছে সপ্তাহের শনিবার।

শনিবার আসলেই তারা আনন্দে মেতে উঠে। টিম মাস্তি প্রতিবাদ করতে চায় ,মাদক দূর করতে চায়। দীর্ঘদিন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের কর্ণদার মাহবুবুল আলম চুন্নু সমাজের সাংবাদিক, শিক্ষক ও কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তরুণ-তরুণীরা যদি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিমনা হয়ে উঠে তাহলে মাদকের থেকে ফিরানো সম্ভব। এই হাজীর বাজারে তাও সংর্কীণ।

মাদকের কাছে এই সমাজের অনেক গৃহবধু অসহায়। প্রতিনিয়ত কিন্ডার গার্ডেনগুলোতে যেই মাদের সন্তান নিয়ে যেতে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানবেন, মাদকসেবী বাবারা ওইসময় ঘুমিয়ে আছে।

মাদকে অনেকেই রাজনৈতিক পদ থেকে আঁচড়ে পড়েছেন। অনেক গৃহবধু অত্মহত্যার পথ বেঁচে নিয়েছেন। আবার অনেকে স্বামী তালাক দিয়েছেন। বেশিরভাগ গৃহবধুরা মাদকের সাথে লড়াই করে সংসার করছেন।

এই অসহায় গৃহবধুদের বাঁচাতে মাদকের শিকড় বিনষ্ট করতে হবে। মণিকা ও রিতীর মতো গৃহবধুরা মাদকসেবী স্বামীর হাতে প্রাণ দিতে না হয়। সেই সমাজ ব্যবস্থা গড়তে প্রশাসনকে সহযোগিতা করা জরুরী।

লেখক পরিচিতি- গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী।

একই রকম খবর

Leave a Comment