মুক্তির মাস মাহে রমজান (২য় পর্ব)

……………………………………… আহম্মদ উল্যাহ ……………………………………

মহানবী (সা.) এর হাদিস থেকে জানা যায় যে, রমযানুল মুবারকের তিনটি দশককে তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বিভূষিত করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, আউয়ালুহু রাহমাতুন ওয়া আওসাতুহু মাগফেরাতুন ওয়া আখেহু ইতকুন মিনান্নারি অর্থাৎ রমযানের প্রথম (দশক) রহমতের দ্বিতীয় (দশক) মাগফিরাতির ও তৃতীয় বা শেষ (দশক) হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির।

রমযানুল মুবারকের তৃতীয় বা শেষ দশকটা অত্যন্ত তাৎপর্যময় রমযানুল মুবারকের এ শেষ দশকেই লাইলাতুল ক্বদর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যে রাত্রি সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন লাইলাতুল ক্বাদরে খায়রুম মিন আলফি শাহর অর্থাৎ লাইলাতুল ক্বদরের রজনী হাজার মাসের রাত্রির চেয়েও উত্তম (আল কুরআন, সূরা ক্বদর)।

উক্ত রজনীর ফাযায়েল সম্পর্কে হাদিস গ্রন্থসমূহে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। যেমন এ মর্মে মহানবী (সা.) বলেন, আন আবিহুরায় রাতা (রা.) ক্বয়ালা ক্বূয়ালা মান ক্বমা লাইলাতুল ক্বাদরে ঈমানাও ওয়া ইহতেছাবাও গুফিরালাহু মা তাকাদ্দামা মিন জান্বিহী অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে খোদা (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদরের রজনীতে ঈমান ও ইহতেছাবের সাথে দÐায়মান অর্থাৎ ইবাদতে মশগুল থাকবে তার অতীত জীবনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ আল বুখারী)। এই লাইলাতুল ক্বদরের এত মর্যাদা এ কারণেই যে এ রাত্রে মহান রাব্বুল আলামীন বিশ্ব পরিচালনার জন্য তার অলঙ্ঘনীয় সংবিধান মহাগ্রন্থ আল কুরআন রমযান মাসে এ রাত্রেই অবতীর্ণের ধারাবাহিকতা শুরু হয়।

এ মর্মে মহান রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন “ওয়াল কিতাবিল মুবীন। ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিম মুবারা কাতিন ইন্না কুন্না মুনযিরীন” অর্থাৎ শপথ এই সুস্পষ্ট প্রকাশকারী কিতাবের, আমি উহাকে এক বড় কল্যাণময় ও গুরুত্বপূর্ণ রাতে নাযিল করেছি, কেননা আমি মানুষকে ভয় বা সাবধান করবার ইচ্ছা করেছিলাম (সূরা দুখান, আয়াত নং-২ ও ৩)।

অনেকের মতে পবিত্র কুরআনুল কারীম ক্বদরের রজনীতে লাওহু মাইফজ থেকে একযোগে প্রথম আসমানে নাযিল হয়। যা হোক লাইলাতুল ক্বদরের বরকতময় রাত্রে যে কুরআনুল কারীমের অংশবিশেষ রাসূল (সা.) এর ওপর ওয়াহী আকারে নাযিল শুরু হয়, তা সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আল কুরআনের অপরিসীম গুরুত্বের কারণেই মূলত লাইলাতুল ক্বদরের এত মর্যাদা।

রমযানুল মুবারকের শেষ দশকেই যে, হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল ক্বদরের উপস্থিতি এ কথা হাদিস গ্রন্থের নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহ থেকে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) আয়েশা (রা.) ইবনে ওমর (রা.), আবু হুরায়রা (রা.) ও আবু সাঈদ (রা.)সহ বহু সংখ্যক বর্ণনাকারীর নিকট থেকে সিহাহ সিত্তার হাদীস সম্ভারে বর্ণনা উৎকলিত রয়েছে। যেমন আন আয়েশাতা (রা.) আন্না রাসূলুল্লাহ (সা.) ক্বয়ালা তাহাররাও লাইলাতাল ক্বাদরে ফিল বিতরে মিনাল আশরিল আওয়াখিরি মিন রামাদান অর্থাৎ আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা লাইলাতুল ক্বদরকে রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রজনীতে তালাশ কর (সহীহ আবু বুখারী)।

অন্য হাদিস, এভাবে এসেছে আন ইবনে আব্বাস (রা.) আন্নাননাবী (সা.) ক্বয়ালা ইতামিসুহলা ফিল আশরিল আওয়াখিরি ফি রামাদানা লাইলাতুল ক্বাদরে ফি তাসিয়াতিন তাব্কী ফি সাবিয়াতি তুবকা ফি খামিছাতি তাব্কা অর্থাৎ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত।

নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা লাইলাতুল ক্বদরকে রমযানের শেষ দশ রজনীতে খোঁজ কর। লাইলাতুল ক্বদর এসব রাত্রিতে আছে- যখন রমযানের ৯, ৭, ৫, রাত বাকি থাকে (সহীত আল বুখারী)। এভাবে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে আরো বর্ণনা এভাবে রয়েছে ক্বয়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) হিয়া ফিল আশরিল আওয়াখিরি ফি তিছয়ী ইয়াবক্বিনা আওফিতিছয়ী ইয়াক্বিনা ইয়ানী লাইলাতুল ক্বাদরে (অর্থাৎ রাসূল (সা.) বলেছেন, লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশ রাত্রে আছে।

যখন নয় রাত অতীত হয়ে যায় কিংবা সাত রাত বাকি থাকে অর্থাৎ ২৯ ও ২৭ তারিখে) এ সমস্ত বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, লাইলাতুল ক্বদর মাহে রমযানের শেষ দশকের যে কোনো বিজোড় রাতে রয়েছে। ঐ মহাবরকতময় রাত্রিকে সুনির্দিষ্ট করে না দেয়ার যে কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে তাহলো অতিপ্রিয় বিষয় অর্জন করার জন্য আনুগত্যশীল বান্দাগণ যেন অতি আন্তরিকতার সাথে শ্রম সাধনায় আত্মনিয়োগ করে এবং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালাকে খুশী করার জন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার বন্দেগি তথা ধ্যান খেয়ালে মগ্ন হয়ে পড়ে।

রমযানুল মুবারকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ইবাদত হলো শেষ দশকে ই’তেকাফ করা। মানুষকে একদিন পৃথিবীর যাবতীয় কর্মকাÐ ও মোহ ত্যাগ করে ক্ববরে তথা আল্লাহর সন্নিধ্যে উপনীত হতে হবে। সেখানে মানুষের নেক আমল ভিন্ন অন্য কিছুই সঙ্গী হবে না। মানুষকে চিরদিনের জন্য যে রাব্বুল আলামীনের নিকট চলে যেতে হবে পার্থিব জীবনেও কিছুদিনের জন্য হলেও চলমান জীবনের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা ত্যাগ করে আল্লাহর ঘরে অবস্থান করে তাকে সর্বান্তকরণে আপন করে নিয়ে তাঁরই স্মরণ ও তাসবিহ এবং সালাতের মাধ্যমে অতিবাহিত করার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়।

মূলত মসজিদে শেষ দশকের এ ই’তেক্বাফ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবে লাইলাতুল ক্বদরকে অর্জন করা।

এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)র বহুসংখ্যক হাদিস বিখ্যাত সাহাবী (রা.) গণের নিকট থেকে বর্ণিত আছে। যেমন আন আয়েশাতা (রা.) আন্নানাবী (সা.) কানা ইয়াতাকিফুল আশরুল আওয়াখিরুমিন রামাদানা হাত্তা তাওফ্ফাহুল্লাহু … অর্থাৎ নবী পতœী আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত।

নবী (সা.) রমযানের শেষ দশদিনে ই’তেকাফে বসতেন। এমনকি এভাবেই তাকে আল্লাহ উঠিয়ে নিলেন এভাবে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে একটি দীর্ঘ হাদিসের অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে- ক্বয়ালা মান কানা ই’তেকাফ মিয়ীয়া ফালইয়াতিকিফাল উয়াশারাল আওয়াখিরা অক্বাদ উরিয়িতু হাজিহীল লাইলাতা অর্থাৎ মহানবী (সা.) বলেন যে, আমার সাথে (মধ্য রমযানে) ই’তেকাফ করেছে সে যেন শেষ দশদিনে ই’তেকাফ করে, কেননা, এই ক্বদরের রাত আমাকে দেখানো হয়েছে, (সহীহ আল বুখারী)।

এসব বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, লাইলাতুল ক্বদরের পুণ্যময় রজনীর ফায়দা হাসিলের জন্যও ই’তেকাফ অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের এই অতুলনীয় বরকতময় রজনীর সওয়াব অর্জনসহ রমযানুল মুবারকের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন। আমীন।

একই রকম খবর

Leave a Comment