…………………………………………………… আহম্মদ উল্যাহ……………………………………………
হাদিস শরিফে এসেছে, ‘রমজানের প্রথম দশক হলো রহমতের, মধ্য দশক হলো মাগফিরাতের, শেষ দশক হলো নাজাতের।’ সাধারণত বলা হয়ে থাকে প্রথম দশকে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমত বা দয়া বর্ষণ করতে থাকবেন। দ্বিতীয় দশকে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে থাকবেন। তৃতীয় দশকে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জাহান্নাম থেকে নাজাত বা মুক্তি দিতে থাকবেন।
প্রশ্ন হলো আল্লাহ যদি রহমত বা করুণা করতে চান, মাগফিরাত বা ক্ষমা করতে চান, নাজাত বা মুক্তি দিতে চান;
তা যতসংখ্যক মানুষের জন্যই হোক না কেন এবং যে পরিমাণেই হোক না কেন; তা তো একমুহূর্তেই করতে পারেন, এতে
১০ দিন সময় কেন লাগবে? আসলে রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বাহ্য অর্থ ছাডাও এর রয়েছে তাত্বিক এক নিগূঢ় রহস্য।
রমজান হলো তাকওয়া অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। তাই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআন কারিমে বলেছেন, “হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; আশা করা যায় যে তোমরা তাকওয়া অর্জন করবে।” (সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে)।
আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর গুণাবলি অর্জন করে সে গুণে গুণান্বিত হোক। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, “আমরা গ্রহণ করিলাম আল্লাহর রং, রঙে আল্লাহ অপেক্ষা কে অধিকতর সুন্দর? এবং আমরা তাঁরই ইবাদতকারী।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৩৮)। যেহেতু মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি, তাই তাকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতে হলে অবশ্যই সেই গুণাবলি অর্জন করতে হবে।
আল্লাহর রং বা গুণ কী? তা হলো আল্লাহ তাআলার ৯৯টি গুণবাচক নাম। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার ৯৯টি নাম রয়েছে, যারা এগুলো আত্মস্থ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসলিম ও তিরমিজি)।
মহান আল্লাহর নামাবলি আত্মস্থ করার বা ধারণ করার অর্থ হলো সেগুলোর ভাব ও গুণ অর্জন করা এবং সেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিজের কাজে-কর্মে-আচরণে প্রকাশ করা তথা নিজেকে সেসব গুণের আধার বা অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা।
রমজান মাসের প্রথম দশক যেহেতু রহমতের বা দয়ার; সুতরাং এই ১০ দিন আমাদের করণীয় হবে আল্লাহ পাকের দয়ামায়া-সংক্রান্ত নামগুলোর জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে এর ভাব ও বৈশিষ্ট্য অর্জন ও অধিকার করে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার চেষ্টা করা এবং আজীবন তার ধারক-বাহক হয়ে তা দান করা বা বিতরণ করা তথা আল্লাহর গুণাবলি নিজের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির কাছে পৌঁছে দেওয়া।
আল্লাহ তাআলার রহমতসুলভ নামগুলো হলো আর রহমানু (অসীম দয়ালু), আর রহিমু (পরম করুণাময়), আল ওয়াদুদু (প্রেমময়), আর রউফু (স্নেহশীল), আল আজিজু (মমতাময়), আল কারিমু (অনুগ্রহকারী), আস সালামু (শান্তিদাতা), আল মুমিনু (নিরাপত্তাদাতা), আল মুহাইমিনু (রক্ষাকর্তা), আল বাসিতু (করুণা বিস্তারকারী), আল মুইজজু (সম্মানদাতা, আল লাতিফু (করুণাকারী), আল মুজিবু (প্রার্থনা কবুলকারী), আর রাজজাকু (রিজিকদানকারী), আল ওয়াসিউ (দয়া প্রসারকারী), আল ওয়ালিয়ু (পরম বন্ধু), আন নাফিউ (কল্যাণকারী), আল হাদিউ (পথের দিশারি), আন নাসিরু (সাহায্যকারী), আল হান্নানু (করুণাশীল) ইত্যাদি।
অতএব, আমাদের করণীয় হবে উক্ত গুণাবলি অর্জন করা এবং আচরণে এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটানো। হাদিস শরিফে আছে, তুমি জগদ্বাসীর ওপর দয়া করো; তবে আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করবেন। (বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি)। আপনি দয়া বা রহমত লাভ করেছেন বা দয়ার অধিকারী হয়েছেন, তা বোঝা যাবে আপনার আচরণে যদি সদা সর্বদা দয়া ও করুণা প্রকাশ পায়; নয়তো নয়। সুতরাং রমজানের প্রথম দশক রহমতের ১০ দিন করণীয় হলো সর্বোচ্চ দয়া প্রদর্শন করা।
আপনি নাজাত বা মুক্তি লাভ করেছেন বা মুক্তির অধিকারী হয়েছেন, তা বোঝা যাবে আপনার আচরণে যদি মোহমুক্ত ভাব প্রকাশিত হয়; নয়তো নয় রমজান মাসের মধ্য দশক যেহেতু মাগফিরাত বা ক্ষমার; সুতরাং এই ১০ দিন আমাদের করণীয় হবে আল্লাহ পাকের ক্ষমা-সংক্রান্ত নামগুলোর জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে এর ভাব-প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য অর্জন ও অধিকার করে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার চেষ্টা করা এবং আজীবন তার ধারক-বাহক হয়ে তা দান করা বা বিতরণ করা তথা আল্লাহর গুণাবলি নিজের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির কাছে পৌঁছে দেওয়া। আল্লাহ তাআলার ক্ষমাসুলভ নামগুলো হলো আল গফিরুন (ক্ষমাশীল), আল গফুরু (ক্ষমাময়), আল গফফারু (সর্বাধিক ক্ষমাকারী), আল আফুউ (মার্জনাকারী), আল খফিদু (বিনয় পছন্দকারী); আশ শাকুরু (কৃতজ্ঞ), আল বাররু (সদাচারী), আল হালিমু (সহিষ্ণু), আস সবুরু (ধৈর্যশীল), আত তাউওয়াবু (তওবা কবুলকারী) ইত্যাদি।
হাদিস শরিফে আছে, অপরাধ স্বীকারকারী নিরপরাধ ব্যক্তির মতো। (বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি)। আপনি ক্ষমা লাভ করেছেন বা ক্ষমার অধিকারী হয়েছেন তা বোঝা যাবে আপনার আচরণে যদি ক্ষমা প্রকাশিত হয়; নয়তো নয়। এতএব রমজানের দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের ১০ দিন করণীয় হলো সর্বোচ্চ ক্ষমা প্রদর্শন করা।
রমজান মাসের শেষ দশক যেহেতু নাজাত বা মুক্তির, সুতরাং এই ১০ দিন আমাদের করণীয় হবে দুনিয়ার সবকিছুর আকর্ষণ ও মোহ থেকে মুক্ত হয়ে প্রভুপ্রেমে বিভোর হওয়া। বিশেষ করে সব ধরনের অন্যায় অপরাধ, পাপ ও গুনাহ, যা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়; যথা: অবৈধ সম্পদ, অন্যায় ক্ষমতা লিপ্সা ও পাপাচার। এগুলো থেকে নিজের মন ও মানসকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা এবং সেসবের আকর্ষণ থেকে পরিপূর্ণরূপে মোহমুক্ত হওয়া।
এবং আল্লাহপাকের স্বয়ম্ভূতা, স্বনির্ভরতা, মুক্ততা ও নিরপেক্ষতা-সংক্রান্ত নামগুলোর জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে এর ভাব-প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য অর্জন ও অধিকার করে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার চেষ্টা করা এবং আজীবন তার ধারক-বাহক হয়ে তা দান করা বা বিতরণ করা তথা আল্লাহর গুণাবলি নিজের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির কাছে পৌঁছে দেওয়া।
আল্লাহ তাআলার স্বনির্ভরতা ও মুক্ততাসুলভ নামগুলো হলো আল আহাদু (একক), আল ওয়াহিদু (এক), আস সমাদু (স্বনির্ভর-অমুখাপেক্ষী), আল আদলু (ন্যায়ানুগ), আল হাক্কু (সত্য), আল কাবিউ (সুদৃঢ়), আল মাতিনু (শক্তিমান), আল কদিরু (ক্ষমতাবান), আন নুরু (জ্যোতির অধিকারী), আর রিশদু (দিব্যজ্ঞানী), আল জামিলু (সুন্দর), আল বাররু (সৎকর্মশীল), আল মুহসিনু (সুকর্তা) ইত্যাদি।
হাদিস শরিফে আছে, দুনিয়ার আকর্ষণ সব পাপের মূল। (বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি)। আপনি নাজাত বা মুক্তি লাভ করেছেন বা মুক্তির অধিকারী হয়েছেন, তা বোঝা যাবে আপনার আচরণে যদি মোহমুক্ত ভাব প্রকাশিত হয়; নয়তো নয়। তাই রমজানের তৃতীয় দশক নাজাতের বা মুক্তির ১০ দিন করণীয় হলো দুনিয়ার সবকিছুর আকর্ষণ থেকে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত হওয়া।
মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের গুণ অর্জন ও আজীবন ধারণ করাই রমজানের মূল শিক্ষা। আল্লাহ পাক আমাদের প্রকৃত দয়া, ক্ষমা ও মুক্তিলাভের তাওফিক দিন। আমিন!
লেখক : ধর্মীয় আলোচক, গবেষক ও
খতিব : ফতেহ্পুর ভূইয়া মার্কেট কেন্দ্রিয়
জামে মসজিদ, লক্ষ্মীপুর সদর।