চাঁদপুর খবর রিপোর্ট : চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডঃ মোঃ জহিরুল ইসলামের স্ত্রী মহিলা আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী ফরিদগঞ্জ গল্লাক ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সিকে (৫০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
আলোচিত এ ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার (৪ জুন) চাঁদপুর শহরের ষোলঘর এলাকায় শেখ বাড়ি রোডে অবস্থিত নিজের চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ।
সোমবার সন্ধ্যার পর কোনো এক সময় নিজ বাসার ভেতরে খুন করা হয় তাকে। । ওই হত্যাকান্ডের পরপরই পুলিশ তাৎক্ষনিকভাবে তার স্বামী অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলামকে এবং মঙ্গলবার ভোরে শহরের নাজিরপাড়াস্থ ভাড়া বাসা থেকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে গ্রেফতার করেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে নিহত ফেন্সির ছোট ভাই মোঃ ফোরকানউদ্দিন বাদী হয়ে তার স্বামী জেলা আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম ,তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগম,স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতা ছোট ভাই খায়রুল ইসলাম নয়ন ও আরেক বোন রানু বেগমকে আসামি করে এই হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জানা গেছে,আটক অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম ,তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন । বিষয়টি গতকাল নিশ্চিত করেন মডেল থানার ওসি ওয়ালি উল্লাহ ওলি ।
এদিকে এ ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে মামলাটি চাঁদপুর মডেল থানা থেকে চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি ) তে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । বর্তমানে এ আলোচিত মামলাটি এখন তদন্ত করবে ডিবি পুলিশ ।মডেল থানা ওসি ও ডিবি’র ওসি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ।
নিহত ফেন্সীর ছোট বোন শাহতলী জিলানী চিশতী কলেজের সহকারী অধ্যাপীক সাহেরা আক্তার দৈনিক চাঁদপুর খবরকে জানান, আমার ছোট ভাই ফোরকান খান বাদী হয়ে এ ঘটনায় অ্যাডঃ জহিরুল ইসলাম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমের এর বিরুদ্ধে চাঁদপুর মডেল থানায় এজহার দাখিল করেছে । তিনি আরো জানান,আমার বোন ফেন্সীকে তার স্বামী অ্যাড.জহিরুল ইসলাম ও ২য় স্ত্রী মিলে খুন করেছে । মাথায় ও বুকে আঘাত এবং গলায় চাপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে । দীর্ঘদিন যাবত আমার বোনকে তার স্বামী নির্যাতন করে আসছে ।সামাজিক মার্যাদার কারণে আমরা তা প্রকাশ করেনি । ঘটনার দিন আমার বোন মার্কেট থেকে কেনা-কাটা করে বাসায় ফিরে । সন্ধ্যার পর পরই এ ঘটনা ঘটে । তার স্বামী ঘটনার পর আমাদের পক্ষের কাউকে মৃত্যুর ঘটনা জানায়নি । তার পরিবারের সদস্যদের জানায় । আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গেছে যে, বেড রুমের ভেতরে খাটের পাশে মেঝেতে অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সির রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। আর লাশের আশপাশে ছোপ ছোপ রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
অ্যাড. জহিরুল ইসলামের সহকর্মী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. আহছান হাবীব জানান, অ্যাড. জহির সোমবার এশা এবং তারাবীহের নামাজ জামাতে ষোলঘরস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মসজিদে আদায় করেন। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে অ্যাডঃ আহছান হাবীবসহ অন্য মুসল্লিরা শুনতে পান, অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামের স্ত্রী খুন হয়েছেন। এমন খবর শুনে তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ঘটনাটি দৈনিক চাঁদপুর খবরকে নিশ্চিত করেন চাঁদপুর বারের আইনজীবি অ্যাডভোকেট মোঃ হেলাল উদ্দিন । তিনি দৈনিক চাঁদপুর খবরকে
জানান,ঘটনাটি জেনে রাত ১১টার দিকে বাসায় গিয়ে দেখি অ্যাডভোকেট জহির সাহেবের স্ত্রী শাহীন সুলতানা ফেন্সীর লাশ মেঝেতে পড়ে আছে । তাকে কে বা কাহারা কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে মনে হলো । পুলিশের সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, আসামিদের আদালতে সমর্পণ করে রিমান্ড চাওয়া হবে। তবে কয়দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে এবং কখন আসামিদের আদালতে পাঠানো হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ।
চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বলেছেন, ফেন্সির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসক তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন। কে বা কারা এই হত্যাকাÐের সঙ্গে জড়িত তা আমরা খতিয়ে দেখছি। ইতিমধ্যেই স্বামী জহিরুল ইসলাম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে আটক করেছে পুলিশ।
চাঁদপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ ওয়ালী উল্লাহ অলি সাথে সাথে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, তিনি জানান রাত সাড়ে ১০টার পর খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। এরপর খুনের ঘটনা দেখতে পেয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। তখন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মো. মিজানুর রহমান এবং আরো বেশ ক’জন পুলিশ ইন্সপেক্টর, পিবিআই ও ডিবি পুলিশ ঘটনাস্থলে আসেন। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট সম্পর্কে ওসি জানান, লাশের মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মাথার মাঝামাঝি স্থানে প্রচÐ আঘাত রয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই অ্যাডঃ জহিরকে আটক করে।
এ ব্যাপারে নিহতের ছোট ভাই ফোরকান খান বাদী হয়ে এজহার দাখিল করেছে । আসামী করা হয়েছে তার স্বামী অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম , তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগম,ছোট ভাই স্থানীয় আওয়ামীলীগের খায়রুল ইসলাম নয়ন ও আরেক বোন রানু বেগমকে।
এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে নিহত অধ্যক্ষ ফেন্সির আত্মীয়-স্বজনরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। নিহতের বড় ভাই ষোলঘর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নঈমুদ্দিন খান ঘটনাস্থলে দৈনিক চাঁদপুর খবরকে বলেন, তার ভগ্নিপতি অ্যাডঃ জহির দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। প্রথম স্ত্রী হচ্ছেন তার বোন ফেন্সি। তার বোনের সংসারে তিন মেয়ে রয়েছে। তাদের তিনজনেরই বিবাহ হয়েছে। দুই মেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। অ্যাডঃ জহিরের দ্বিতীয় বিবাহ করা নিয়ে তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহ লেগেই থাকতো। তিনিসহ অন্য ভাই-বোনরা জোর দিয়ে বলেন, অ্যাডঃ জহিরই তার স্ত্রীকে খুন করেছে। নিহতের ভাই ষোলঘর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু নঈম আরো জানান, ফেন্সিকে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার ধারণা-তাকে ইফতারের আগেই হত্যা করা হয়েছে। কারণ, তার হাতে ব্যাগ এবং পায়ে মোজা ছিল। এ থেকে ধারণা করছি, সে বাসায় আসার পরপরই তাকে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করা হয়। এতে তার মাথার মগজ বেরিয়ে যায়।
তিনি জানান, হত্যার পর তার স্বামী জহিরুল ইসলাম দোকানে গিয়ে বেশ কয়েকটি সিগারেট পান করেন।
অ্যাডঃ জহির দ্বিতীয় বিবাহ করেন প্রায় বছর পাঁচেক আগে। দ্বিতীয় স্ত্রীর গ্রামের বাড়ি মতলব উত্তর উপজেলায়। তার নাম জুলেখা বেগম। থাকেন চাঁদপুর শহরের নাজিরপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায়। এ সংসারে অ্যাডঃ জহিরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী শাহিন সুলতানা ফেন্সির পৈত্রিক বাড়ি চাঁদপুর পৌরসভার ১৩নং ওয়ার্ডস্থ বাহের খলিশাডুলি গ্রামে।
অপরদিকে অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলামের বাড়ী চাঁদপুর সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নে ।
তিনি চাঁদপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিন সভানেত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য। খবর পেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ অনেক নেতা ও আইনজীবী ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেন ।
পুলিশ বলছে, প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, কোন শক্ত বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফেন্সিকে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। আঘাতের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, এর কারণে ফেন্সির মাথার মগজ পর্যন্ত বেরিয়ে যায়। আর তাতেই তার মৃত্যু হয়। অধ্যাপিকা শাহীন সুলতানা ফেন্সি তিন কন্যা সন্তানের জননী। তার দুই মেয়ে ইউরোপে এবং এক মেয়ে কুমিল্লাতে অবস্থান করে। তার স্বামী অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম বেশীর ভাগ সময়েই শহরের নাজিরপাড়ায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী’কে নিয়ে বসবাস করতেন। তবে মাঝে মধ্যে ফেন্সির বাসায়ও এসে রাত্রি যাপন করেন। পাঁচ বছর আগে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় করা দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে ফেন্সির সাথে তার বিরোধ ও মনোমালিন্য চলে আসছিল। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জহিরের আরেকটি কন্যা সন্তান রয়েছে। ফেন্সি বেশিরভাগ সময়ই বাসায় একাই থাকতেন। ফেন্সির ভাই-বোনদের দাবি তাদের বোনকে বোন জামাই অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলামই খুন করেছে। এদিকে পারিবারকি সূত্রে জানা গেছে, নিহতের অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সির জানাজা বুধবার (৬ জুন ) অনুষ্ঠিত হবে ।