মোঃ সোলাইমান ঃ আলহাজ্ব আব্দুস সাত্তার মিয়া চেয়ারম্যান চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার নলুয়া গ্রামে এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ২মে ১৯৩৬ ইং সালে জম্মগ্রহন করেন।
তিনি মুুক্তিযুদ্ধের বহু আগে থেকেই তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কাপড় ব্যাবসায়ী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেশের স¦াধীনতার জন্য সক্রিয় আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে নিজেকে সক্রিয় করেন। মুুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন না করলেও ব্যবসার সুবাধে কচুয়া বাজার এবং রহিমানগর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার খোঁজ খবর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন।
এ কারনে ১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসের এক শুক্রবার স্থানীয় রাজাকার আরিক্কা বাহিনী ওনার বাড়ী আক্রমন করে এবং ৭ টি বড় নৌকা লুটতরাজ করা মালামাল দিয়ে বোঝাই করে। উনি ছোট একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে পালিয়ে কোনো রকমে প্রানে রক্ষা পান। রাজাকার বাহিনী ঐ দিন পুরো বাড়িতে এমনভাবে লুটতরাজ করে যে ভাত খাওয়ার একটি প্লেটও ছিল না, রান্না করার এক মুষ্টি চাউল ছিল না, এমন কি পরার জন্য দ্বিতীয় কোন লুঙ্গি বা কাপড় ছিল না।
রাজাকার বাহিনী লুটতরাজ শেষে বাড়ী-ঘরে আগুন দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় তখন চেয়ারম্যান সাহেবের বাবা হাজী ইদ্রিছ মুন্সি অনেক অনুনয় বিননয় করেন, পরে সাত্তার সাহেবকে কচুয়া বাজারে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে হাজির করাবেন এই শর্তে আগুন দেয়া বন্ধ রাখে। কয়েকদিন পর সকল ভয় ভীতি ডিঙ্গিয়ে আঃ সাত্তার সাহেব কচুয়া রাজাকার ক্যাম্পে হাজির হন। অনেক শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে উনাকে প্রত্যেক দিন রাজাকার ক্যাম্পে হাজির হ্ওয়ায় শর্তে ছেড়ে দেয়া হয়।
এতে অবশ্য লাভ হয়েছে, রাজাকার এবং পাকিস্তানীরা কোন এলাকায় যাবেন এবং তাদের কি পরিকল্পনা সেটা জেনে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করতেন শুধু তাই নয়, তাঁর বাড়িতে গভীর রাত্রে তার সহধর্মিনী রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার খাওয়াতেন । তিনি মুক্তিযোদ্ধের একজন সংগঠক, একজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা সর্বোপরি একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক ছিলেন। অথচ তিনি মুক্তিযোদ্ধের কোন স্বীকৃতি পাননি। অথচ দেশে অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত হয়।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট জাতির জনক সপরিবারে শাহাদাত বরন করেন। পরের বছর তিনি ১৯৭৬ সালে প্রথম বারের মত কচুয়া উপজেলার ৯ নং কড়ইয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন্।
এর পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। কুমিল¬া টাউন হলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের এক সম্মেলনে প্রশ্ন করেন, “এই সম্মেলনে আওয়ামীলীগ করেন এমন কোন চেয়ারম্যান উপস্থিত আছেন কি?” তখন এক মাত্র হাজী আব্দুস সাত্তার চেয়ারম্যান সাহসের সাথে দাঁড়িয়ে গৌরবের সহিত উত্তর দেন “জ্বি, জনাব আমি আওয়ামীলীগ করি।” প্রেসিডেন্ট জিয়া তখন স্তম্ভিত হয়ে যান। সকলে তাকিয়ে এ দৃশ্য দেখে আশ্চর্য্য হয়ে যান।
তিনি ১২ বছর যাবত নিচু ভূমি তথা জলার এলাকা হিসেবে খ্যাত কচুয়া উপজেলার কড়ইয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তিনি অসংখ্য নতুন নতুন মাটির রাস্তা এবং ব্রিজ, কালভার্ট তৈরী করে নিজ এলাকায় ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন এবং মানুষের যাতায়াতের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করেন।
কিন্তু এলাকায় নতুন নতুন রাস্তা তৈরী করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন মামলা-মোকাদ্দমার সম্মুখিন হন। তিনি কচুয়া উপজেলার সাহেদাপুর, দৌলতপুর এবং নলুয়া গ্রামের সংযোগস্থলে নলুয়া বাজার তৈরী করেন। নলুয়া বাজারের পূর্ব পার্শ্বে ৩০ শতক জায়গা দান করে “কড়ইয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র” প্রতিষ্ঠিত করেন, যা বর্তমানে এলাকার মানুষকে স¦াস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে ।
নলুয়া বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে ৩০ শতক জায়গা দান করেন “নলুয়া দৌলতপুর শিশু সদন প্রাথমিক বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠিত করেন। স্কুলের উত্তর পার্শ্বে ২১ শতক জায়গা দান করে চেয়ারম্যান সাহেবের পিতার নামে “হাজী ইদ্রিছ মুন্সি শিশু সদন” নামে ১টি এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত করেন। এতিমখানার পার্শ্বে ৬ শতক জায়গা ওয়াক্কফ করে ” মদিনা জামে মসজিদ” প্রতিষ্ঠিত করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ৯১ শতক জায়গা দান করে এবং সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্টানে জড়িত থেকে নিজেকে একজন দানবীর সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিনত করেছেন।
তাছাড়া তিনি আমৃত্য বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্টানের উন্নয়ন কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন দেন-দরবার সুষ্ঠভাবে সমাধান দেওয়ার সুনাম এখনও এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
মানুষের যে কোন আপদ বিপদে সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তিনি দূর দুরান্তে ছুটে যেতেন। গত বিএনপি জামাত জোট সরকারের শাসনামলে তিনি আওয়ামীলীগের উপজেলা সিনিয়র সহ-সভাপতি হওয়ার কারনে প্রায় ৪ বৎসর কচুয়ার বাহিরে পালিয়ে বেড়ান। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধের স্বপক্ষের দেশ প্রেমিক নাগরিক ছিলেন।
তিনি একজন খাটি ধর্মপ্রান মানুষ ছিলেন। তিনি ৫ বার পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করেছেন। তিনি খাজা মাইনুদ্দিন চিশ্তি (রহঃ) মাজার জিয়ারত করেছেন। তিনি চট্রগ্রামের মাইজভান্ডারশরীফের মাওলানা হযরত আলহাজ্বু শাহ্সুফি শফিউল বশর মাইজভান্ডারী (রহঃ) এর মুরিদান ছিলেন। পঞ্চমবার হজ্জ্ব পালন করে আসার পরে তিনি ডায়াবেটিকস রোগে আক্রান্ত হন।
চিকিৎসার জন্য তিনি ২ বার ভারত গমন করেন। তিনি গত ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে মাইল্ড ষ্ট্রোক করার পর ঢাকায় এপোলো হাসপাতালের ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল সকালবেলা নিজ বাড়ীতে ব্রেইন ষ্ট্রোক আক্রান্ত হন। সেখান থেকে উনাকে ঢাকায় এপোলো হাসপাতালে আইসিইউ-তে ভর্তি করা করা হয়। ৯ দিন আইসিইউ-তে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত ১৬-ই এপ্রিল ২০১৯ ইং এপ্রিল সন্ধা ৬.৩০ ঘটিকায় ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি…………..রাজেউন )।
মৃত্যূকালে তিনি স্ত্রী, ৫ পুত্র, ২কন্যাসহ আত্বীয়-স্বজন ও অসংখ্য গুনগ্রাহীরেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যতে গভীর শোকও সমবেদনা জানিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ মহীউদ্দীন খান আলমগীর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার জনাব আবদল মান্নান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (রাজস্ব) জনাব মোঃ জামাল হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব নিলীমা আফরোজ, কচুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জনাব শাহজাহান শিশির, কচুয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আইয়ুব আলী পাটওয়ারী এবং উপজেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী সোহাগ চৌধুরী সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
মৃত্যূর পরদিন নলুয়া গ্রামের নিজ বাড়ীতে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় এলাকার কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহন করেন। জানাজায় উপজেলা চেয়ারম্যান শিশির আহমেদ, উপজেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী সোহাগ চৌধুরী, কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান সহ আওয়ামীলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
চাঁদপুর এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী সহ কচুয়া উপজেলা প্রশাসনের প্রায় সকল কর্মকর্তা জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। জানাজা শেষে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মদিনা জামে মসজিদের পার্শ্বে মরহুমের পিতা হাজী ইদ্রিস মুন্সির কবরের পার্শ্বে পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
দাফন কাজ শেষে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (রাজস্ব) এবং কচুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাঁর প্রতি কবরে ফাতেহা পাঠ করেন। উনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন উনার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং মানুষ উনাকে স্মরন করবে উনার কর্মের মাধ্যমে। এমন একজন দেশপ্রেমিকের প্রতি রইল অপরিশীম শ্রদ্ধাঞ্জলি। মহান আল¬াহতায়ালা জনাব আব্দুস সাত্তার চেয়ারম্যানকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আমিন!!!