হাজীগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে ছুটি না নিয়ে ৫ চিকিৎসক ভ্রমণে!

শওকত আলী: চাঁদপুর জেলার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ন ও মডেল শহর হচ্ছে হাজীগঞ্জ। এ উপজেলার প্রায় সাড়ে ৩ লাখ স্বল্প আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকদের চিকিৎসার জন্য একমাত্র ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

এ হাসপাতালে যে সমান্য খাবার দেয় তাতে অনেকে জীবন বাচাঁতে বাধ্য হয়ে সে খাবার খেতে হয়। সকালে সামান্য নাস্তা, দুপুরে ও রাতে খাবার দেয়া হয়। গরীব রোগীদের যে খাবার দেয়, তাতে তাদের পেট ভরে না।

এসব সামান্য খাবারে জীবন বাচাঁতে সে খাবারই খেতে হয় বাধ্য হয়ে। একজন রোগী তার অনভুতিতে বলেন,অনেক রাত হলে পেটের খিদায় পেট জ্বলতে থাকে। তখন পানি খেয়ে কোন রকমে সময় পার করি।
কিন্তু হাসপাতালের গাইনি, অর্থপেডিক, চক্ষু চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ বহু বছর যাবত চিকিৎসক নেই। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ।

প্রতিদিন বহির বিভাগে ৫০০ থেকে ৭০০ রোগী আসেন চিকিৎসা সেবার জন্য। চাহিদার আলোকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ছুটে যান প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোতে। হাসপাতালের দায়িত্বশীল ৫ চিকিৎসকসহ ৭জন কর্মকতা ছুটি না নিয়ে আছেন ভ্রমন বিলাসে। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সটি চিকিৎসক ঘাটতি পুরনসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ দাবী ভুক্তভোগী হাজীগঞ্জ বাসী ও উপজেলার সচেতন মহলের।

হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগে কথা বলে জানাগেছে, বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন ২৯জন। এর মধ্যে দুইজন কর্মস্থল এখানে হলেওস ডেপুটেশনে কাজ করেন অন্য হাসপাতালে। গাইনি চিকিৎসক ডাঃ সাবরিনা কাদির যোগদানের পর একমাস দায়িত্ব পালন করে না বলেই চলেগেছেন। এক বছরেরও অধিক সময় এই পদশূন্য।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, শনি ও রবিবার (২৯ ও ৩০ এপ্রিল) উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম মোঃ নাইম, আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ জামাল উদ্দিনসহ ৫জন চিকিৎসক উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ছুটি না নিয়ে ভ্রমনে আছেন। এছাড়াও আগ থেকে আরো ৬জন আছেন ছুটিতে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ও আরএমও এর কক্ষে গিয়েও তাদেরকে পাওয়া যায়নি।

সরেজমিন শনিবার (২৯ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে দেখগেছে-বহির বিভাগে অনেক রোগী এসেছেন চিকিৎসার জন্য। নারী-পুরুষ মিলিয়ে রোগী হবে ৫শ’ থেকে ৬শ’। পুরো হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসক পাওয়াগেল ৩জন। একজন নাক-কান-গলার চিকিৎসক, একজন নারী ও আরেকজন পুরুষ চিকিৎসক।

ভাঙা হাত নিয়ে বহিরবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা যুবক আরমান বলেন, ১০টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছি ডাক্তার দেখাব। কিন্তু এই বিভাগের ডাক্তার নেই। যিনি দেখবেন তার চিকিৎসাই নিতে হবে।

৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন প্রায় প্রায় ২৫জন। এর মধ্যে অধিকাংশ রোগী নারী। উপজেলার তারালিয়া গ্রামের চিকিৎসাধীন রোগী হালিমা বেগম জানান, হাসপাতাল থেকে যে খাওয়া দেয়া হয়, সেগুলো খাওয়া যায় না। বাহির থেকে এনে খেতে হয়। আবার অনেকে জীবন বাচাঁতে বাধ্য হয়ে সে খাবার খেতে হয়।

একই উপজেলার অলিপুর থেকে আসা রোগী তাহমিনা বেগম জানান, যারা চিকিৎসা দিতে আসেন তারা নার্স নাকি চিকিৎসা বুঝি না। তবে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একজন এসেছেন বোরকা পরে চিকিৎসা দিতে।

এনায়েতপুরের রেহেনা বেগম (৪৫) জানান, রোগীর চিকিৎসা বুঝে খাবার দেয়া হয়। সকালে নাস্তা, দুপুরে ও রাতে খাবার দেয়া হয়। আমরা গরীব মানুষ যে খাবার দেয়, তাতে পেট ভরে না। এসব সামান্য খাবারে জীবন বাচাঁতে সে খাবারই খেতে হয়। অনেক রাত হলে পেটের খিদায় পেট জ্বলতে থাকে। তখন পানি খেয়ে কোন রকমে সময় পার করি।

পৌর এলাকার রোগী আঞ্জুমা বেগম বলেন, হাসপাতালের খাবার খাইনি। বাসা থেকে এনে খাই। কোন ডাক্তার চিকিৎসা দেয় বলতে পারিনা। কারণ আমাদের চিকিৎসার ফাইল নার্সদের কাছে থাকে। আঞ্জুমার বাবা মো. ওমর আলী বলেন, এই হাসপাতাল থেকে কোন সরকারি ঔষধ পাওয়া যায় না। বাহির থেকে সব ঔষধ কিনে আনতে হয়।

উপজেলা সদরের একাধিক রোগী ও অভিভাবক জানান, হাসপাতালের কর্মকর্তাসহ ১১জন যদি ছুটিতে থাকেন। তাহলে কিভাবে হাসপাতালে পরিচালনা করা হয়। হাসপাতালটি এখন অভিভাবকহীন। হাসপাতালের সার্বিক বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারী করা প্রয়োজন।

নার্সদের রুমে গিয়ে দেখাগেল সবাই গল্প করছেন। পরিবেশ খুবই নোংরা। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনাদের দায়িত্বরত নার্সকে। তারা জবাব দিলেন সবাই আমরা দায়িত্বশীল। তবে পরে জানাগেলে তাদের দায়িত্ব আছেন সিনিয়র নার্স পুতুল। তার পদবী সুপারভাইজর। তিনি বলেন, যারা এখানে নার্স হিসেবে কাজ করেন তারা অনেকেই অনেক সময় আমার নির্দেশনা পালন করেন না। পরিস্কার রাখার চেষ্টা করি। ভবিষ্যতে আরো ভাল পরিবেশ করার চেষ্টা করব।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ জামাল উদ্দিন মুঠো ফোনে বলেন, তিনি ছুটিতে আছেন। হাসপাতালের আভ্যন্তরীন পরিবেশ সুন্দর রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি একবছর হয়েছে এখানে যোগদান করেছেন। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঠিকমত কাজ করেন না। যে কারণে অনেক সময় ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকে। তবে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা দেয়ার বিষয়ে তাদের কোন ত্রুটি নেই।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পলিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম মো. নাইম মুঠো ফোনে বলেন, ছুটি না নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সঠিক না। ৫জন চিকিৎসক ছুটি না নিয়ে যেতে পারে না। আমরা ৫জনসহ আরো ৬জন ছুটিতে আছেন। তবে সেবা দেয়ার জন্য আজকে (৩০ এপ্রিল) ১৩জন চিকিৎসক থাকবে।

তিনি আরো বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসক ঘাটতি বহু বছরের। আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখেছি। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা অনেকদিন বেতন পায়নি। এই পদে নিয়োগ নেই। অনেক রোগী আসে প্রতিদিন। সে জন্য অপরিচ্ছন্ন হয়ে যায়।

এ সব অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ সাহাদাৎ হোসেন এর সরকারি মোবাইল নম্বরে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,আমার কাছ এক তার মেয়ের পরীক্ষা আছে বলে ছুটি দিয়েছে। বাকীরা আমার কাছ থেকে ছুটি নিবে না। তাদের কর্মকর্তা অন্যরা। তার পরও বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিব।

একই রকম খবর